ছবি : সংগৃহীত

ভাবলেশহীন মুখাবয়ব, বেদনাস্নাত দুটি চোখ, সামনে বেশ কয়েকটি বুম। ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদ সাক্ষাৎকার সংগ্রহের সেই ধাতব ডান্ডাগুলোর দিকে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন সদ্য মা হারা এক সন্তান। সাংবাদিকবৃন্দ অথবা সাক্ষাৎকার সংগ্রাহকরা হয়তো স্নেহশীল হৃদয়েই জানতে চেয়েছেন, তার অনুভূতি!

সংবেদনশীলভাবেই হয়তো জিজ্ঞাসা করেছেন, আগামীর দিনগুলো ঠিক কীভাবে কাটবে? মায়ের কোন বিষয়টি বেশি অনুভব করবেন? ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন নিদারুণ বেদনাবিধুর সময়ে মা হারা কোনো শিশু সন্তানকে কি এমন প্রশ্ন করা যায়? কোনো অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ বা বাধ্য করা যায়? এটা কি সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে? খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো আচরণ বিধির মধ্যে পড়ে?

অভিনয়শিল্পী রিশতা লাবনী সীমানা ৪ জুন ২০২৪ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্যভূবনে পাড়ি জমিয়েছেন। রেখে গেছেন দুই অবুঝ সন্তান শ্রেষ্ঠ ও স্বর্গ’কে। শেষ বিদায়ের দিন চ্যানেল আই’-এর প্রাঙ্গণে এই শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানান তার স্বজন, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

এই সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই সবার দৃষ্টি ছিল মা হারানো দুই সন্তানের দিকে। অসময়ে মা চলে যাওয়ায় এই দুই নাবালক সন্তান ঠিক কী হারালেন তা অনুভব করা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব। কিন্তু সেই অনুভূতি জানার জন্যই ব্যাকুল ছিলেন সাংবাদিকবৃন্দ। যে কারণে সব ধরনের নৈতিকতা ও সহজাত মানবিক মূল্যবোধ পায়ে মাড়িয়ে তারা এক শিশু সন্তানের মুখের সামনে বুম ধরেছেন। জানতে চেয়েছেন অনুভূতি! 

....এমন নিদারুণ বেদনাবিধুর সময়ে মা হারা কোনো শিশু সন্তানকে কি এমন প্রশ্ন করা যায়? কোনো অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ বা বাধ্য করা যায়? এটা কি সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালার মধ্যে পড়ে?

সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করেছে। অন্য দু-চারজন নাগরিকের মতো আমার মনেও প্রশ্ন, দায়িত্বরত সাংবাদিকরা কি কাণ্ডজ্ঞান বাড়িতে রেখে এসেছিলেন? যদিও ভিউ বাণিজ্যের এই যুগে খুব সম্ভবত এসব নেতিবাচক, অগ্রহণযোগ্য আচরণ—স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা করতে সাংবাদিকরা আর সংকোচ বোধ করেন না। ভিউ বাণিজ্য বা ক্লিক-ই এখন প্রধান বিবেচ্য।

আরেকটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ৯ মে ২০২৪ মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পাইলট আসিম জাওয়াদ। সংবাদ মাধ্যমের জন্য বেশ বড় এই ঘটনার খবর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ব্রেকিং নিউজ আকারে সম্প্রচার করে। চলে টানা লাইভ।

তবে এই দুর্ঘটনার দুঃখজনক একটি নগ্নরূপ আমাদের সামনে সম্প্রচারিত হয় ওইদিন বিকেলবেলা। নিহত পাইলটের বাবা-মা থাকেন মানিকগঞ্জ শহরে। খুব স্বাভাবিকভাবেই টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ছুটে যান সেই জায়গায়। এই সময় দেশের প্রথম সারির ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেল সময় টিভি’তে লাইভ চলছিল।

প্রতিবেদক অবস্থান করছিলেন নিহত অফিসারের ফ্ল্যাটের ভেতরে। সরাসরি সম্প্রচারে চ্যানেলটির প্রতিবেদক নিহত পাইলটের মা নিলুফার খানমের মাতমের বর্ণনা দেন। এক পর্যায়ে প্রতিবেদক নিজে আউট অব ভিশনে গিয়ে সরাসরি পুরো ফ্রেমে দেখাতে থাকেন সদ্য সন্তান হারানো এক মায়ের আহাজারি।

এই সময় খুব স্বাভাবিকভাবেই নিলুফার খানমের পোশাক সরে যাচ্ছিল। ছেলে হারানোর পর কোন বাবা-মা’ই না, মাতম করতে থাকেন। তখন কি তাদের অন্যদিকে নজর থাকে? স্বজনরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছিলেন মা’কে সান্তনা দেওয়ার।

লাইভে খুঁটিনাটি সম্প্রচার হয়েছিল লম্বা সময় ধরে। সদ্য সন্তান হারানো এক মায়ের শোক প্রকাশের এই দৃশ্যগুলো টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো কি জরুরি ছিল? এটা কি আসলে সাংবাদিকতা? ব্যাপারটা খুবই রুচিহীন ছিল। নিশ্চিতভাইে এটি ছিল খারাপ একটি দৃষ্টান্ত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার চূড়ান্ত লঙ্ঘন। প্রশ্ন হলো, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের একবারও কি বিষয়টা মাথায় আসেনি?

ক্লিকবেইটের প্রসার ও গণমাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেন?

ক্লিকবেইট (Clickbait) শব্দটির উৎপত্তি ২০০৬ সালে। ব্লগার জে. বেইগার (Jay Beiger) প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এই শব্দটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। Click এবং Bait। এখানে ক্লিক বলতে বোঝানো হয়েছে কম্পিউটারের একটি কমান্ড আর Bait শব্দের অর্থ কোনো কিছু শিকার করা। শব্দগত অর্থ দাঁড়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ক্লিক শিকার করা বা ক্লিক আদায় করে নেওয়া। আর ধারণাটি যুক্ত হয় যেকোনো শিরোনামের সাথে।

হতে পারে ছবির শিরোনাম, ভিডিও’র শিরোনাম অথবা সংবাদের শিরোনাম। ২০০৬ সালের প্রথম ব্যবহারের পর মাত্র এক দশকের মধ্যে এই শব্দটি মর্যাদাপূর্ণ অক্সফোর্ড অভিধানে যুক্ত হয়। বর্তমানে অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী Clickbait এর অর্থ ‘material put on the internet in order to attract attention and encourage visitors to click on a link to a particular web page’.

বর্তমান ইন্টারনেট যুগে মানুষ বেশিরভাগ সংবাদের সূত্র বা লিংক পেয়ে থাকেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজে। আর তাই এই লিংকগুলোর শিরোনাম ও আধেয়তে আটকে রাখা বর্তমান সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

মূল কথা হলো, যত ক্লিক, তত ভিউ, তত টাকা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমগুলো নীতি-নৈতিকতা ও অতি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। যার উদাহরণ আমরা প্রায় প্রতিনিয়ত দেখছি বিভিন্ন ধরনের সংবাদমাধ্যমে। আরও দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

৭১ টেলিভিশনের ‘খেলাযোগ’ তাদের ফটোকার্ড তৈরি করেছেন—‘চলে গেলেন মুশফিক’ শিরোনামে। তারকা ক্রিকেটার মুশফিক মারা যাননি, তিনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আউট হয়েছেন। চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের অনলাইন পেইজে সংবাদের শিরোনাম—‘এমপি আনারের ৪ কেজি মাংস উদ্ধার’ (২৮ মে, ২০২৪) ইত্যাদি।

নীতিমালার নীতি-নৈতিকতার উপ-ধারায় বলা হয়েছে, একজন সম্প্রচার সাংবাদিককে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে....

এমনকি দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোও খুব আলোচিত একটি বিষয় থেকে ব্যবসায়িক সুবিধা নেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনের শিরোনাম করেছে—‘বিক্রি হচ্ছে প্রথম আলো’ (৩০ এপ্রিল ২০২৪)।

মূল কথা হচ্ছে, বর্তমান ইন্টারনেট যুগে ক্লিকবেইট (Clickbait) থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ কম। কিন্তু এই ধারণার ব্যবহার গণমাধ্যমে আধেয় তথা সংবাদে ব্যবহার করায় মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। যার সাথে ক্ষয় ও লয় ঘটছে সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতা চর্চায়। যা বন্ধ হওয়া জরুরি।

গণমাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মানা জরুরি কেন?

সংবাদ মানুষের জন্য। আবার মানুষই সংবাদের মূল উপাদান, উৎস। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তার বৈশ্বিক অধিকার, মানবাধিকার। তাই বিভিন্ন নীতি, নীতিমালা ও আইনে একজন মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।

গণমাধ্যম, গণমাধ্যমের আধেয়, নীতিমালা ও আইনেও বিষয়টি আছে। যেমন বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। সম্প্রচার মাধ্যমের অনুষ্ঠান, সাংবাদিকতা ও বিজ্ঞাপনে এক ধরনের শৃঙ্খলা আনতে এই নীতিমালা।

এতে সম্প্রচার সাংবাদিকতা ও সম্প্রচার মাধ্যমের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, সম্প্রচারের অন্যায্য (Unjust), অনুচিত (Unfair) বিষয়াদি পরিহার এবং গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করে (Infringement of privacy) এমন বিষয়গুলো দেখভাল করতে বিভিন্ন ধরনের বিধানের কথা বলা হয়েছে।

জরুরি হলো, নীতিমালায় গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করে (Infringement of privacy) বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। খুব সরল কথা, একবার কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হলে সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। ঘটতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। যা কখনোই কাম্য নয়। 

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্প্রচার সাংবাদিকতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা রয়েছে। যাতে বর্ণবাদ, শিশু-নারীর অধিকার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার, অশ্রাব্য শব্দের ব্যবহার নানা বিষয়ে দিক নির্দেশনা আছে। এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে বিবিসি’র Broadcast media and regulation শিরোনামের নীতিমালাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ প্রাসঙ্গিক।

এই নীতিমালার নীতি-নৈতিকতার উপ-ধারায় বলা হয়েছে, একজন সম্প্রচার সাংবাদিককে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে। তাতে বলা হয়েছে ‘respecting people’s privacy, particularly in times of grief, illness or shock’.

একজন সাংবাদিককে অবশ্যই দুঃখ, অসুস্থতা ও শোকের সময় মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করতে হবে। আর যে বিষয়টিই লঙ্ঘিত হয়েছে অভিনয় শিল্পী রিশতা লাবনী সীমানার সন্তানের ক্ষেত্রে, লঙ্ঘিত হয়েছে নিহত পাইলট আসিম জাওয়াদের মায়ের শোক প্রকাশের ক্ষেত্রেও। হয়তো খুঁজলে এই রকম উদাহরণ আরও পাওয়া যাবে সহজেই।

সাংবাদিকতা খুবই সংবেদনশীল পেশা। এই পেশার অপর নাম দায়িত্বশীলতা। যেখানে নীতি-নৈতিকতার লঙ্ঘন ও অসংবেদনশীল আচরণ একেবারেই অগ্রণযোগ্য। এতে পুরো গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। মানুষের আস্থা কমে যায়। এমন বাস্তবতায় সাংবাদিকদের কাছ থেকে সংবেদনশীল ও পেশাদার আচরণই কাম্য। ভিউ বাণিজ্য নয়, বস্তুনিষ্ঠতায় হোক সংবাদের লক্ষ্য। 

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
minhaz_uddin_du@yahoo.com