ছবি : সংগৃহীত

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যা হয়। উজানের পানি ভাটি অঞ্চল দিয়ে নেমে বঙ্গোপসাগরে যায়। বন্যার সাথে তাই আমাদের নিত্য বসবাস। বন্যা নিছক অভিশাপ নয়, এই বদ্বীপের জন্য বন্যা আশীর্বাদও। নিয়মিত বন্যা হয় বলেই আমাদের ভূমি উর্বরা।

বানের জলে ভেসে আসা পলিমাটিতে বীজ ফেললেই ফসল হয়। আর এই উর্বরা ভূমির কারণেই ছোট্ট দেশে ১৮ কোটি মানুষ খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে। বন্যা প্রতিবছরই হয়, তবে কখনো কখনো বন্যা এসে ভাসিয়ে নেয় সবকিছু। বেশকিছু বড় বন্যার স্মৃতি আছে আমাদের।

ছেলেবেলায় ১৯৭৪ সালের বন্যার কথা বেশ মনে আছে। তখন অবশ্য বন্যার ভোগান্তিটা আমরা বুঝিনি। ঘরের ভেতরে পানি, খাটে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যায়, এই আনন্দটাই মনে আছে কেবল। তবে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের আরও অনেক অঞ্চলের মতো দাউদকান্দিতে আমাদের এলাকাও তলিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ডুবে ছিল দিনের পর দিন।

আমাদের গোটা এলাকায় একটা ব্রিজের দুই পাশের সামান্য অংশ ছাড়া কোথাও মাটি ছিল না। পুরুষ মানুষেরা সাঁতরে সেই ব্রিজের কাছে চলে যেতাম। সারাদিন সেইখানে কাটিয়ে রাতে আবার সাঁতরে ঘরে ফিরতাম। নৌকায় দল বেঁধে বিলের মাঝখানে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতাম। আমার ঠিক মনে নেই, নারীরা কীভাবে রান্নাবান্না করতো বা প্রাকৃতিক কাজ সারতো। তবে অন্তহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। কে কার পাশে দাঁড়াবে। বন্যা সবাইকে নামিয়ে এনেছিল এক কাতারে।

ঝড়-বন্যা নিয়মিত ঘটনা বলে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উঁচু করা হয়েছে। এখন আর ডুবে যাওয়ার শঙ্কা নেই। সেই বন্যায় ডুবে গিয়েছিল ঢাকা শহরের অনেক এলাকাও। 

এই যে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তারপরও সিলেট বারবার বন্যার পানিতে ডুবে যায় কেন? এর উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। উত্তরটা সহজ, কাজটা ঠিকমতো হয়নি। টাকাটা আসলে জলে গেছে।

বন্যার পর ঢাকাকে রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই বাঁধ পরে বন্যা থেকে ঢাকাকে আগলে রেখেছে। শুধু ঢাকা নয়, অনেক জায়গায় বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বাঁধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কেন যেন মনে হয় সিলেট বুঝি বাংলাদেশের বাইরে। ২৯ মে থেকে গত কয়েকদিনে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা দফায় দফায় প্লাবিত হয়েছে। এই প্লাবনে কোনো আশীর্বাদ নেই। পুরোটাই অভিশাপ।

সিলেট শহরে অনেক এলাকায় রাস্তা তো বটেই পানি উঠে গেছে ঘরে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভেতরটা পানিতে সয়লাব হওয়ার ছবি ছাপা হয় গণমাধ্যমে। সারাদেশের মানুষ যখন পবিত্র ঈদুল আযহার আনন্দে মশগুল, পশু কোরবানিতে ব্যস্ত; তখন সিলেটের লাখো মানুষ পানিবন্দী। তাদের অনেকেই এবার সামর্থ্য থাকলেও কোরবানি দিতে পারবেন না। সিলেটে যে এবারই প্রথম বন্যা হলো তা নয়।

ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে সুরমা-কুশিয়ারা উপচে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়মিতই প্লাবিত হয়। কখনো আকস্মিক ঢল ভাসিয়ে নেয় হাওরে ফসল। এবার যেমন ভারতের চেরাপুঞ্জিতে প্রবল বৃষ্টির কারণে সিলেট শহর প্লাবিত হয়েছে। ১৫ দিনে চারবার বন্যা সিলেটের মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ফেলেছে।

প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে আমরা পারবো না। বৃষ্টি, ঢল, বন্যা ঠেকানোর সাধ্য আমাদের নেই। তাই বন্যা আসবেই। আমাদের সেইটা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। নিয়মিত নদী খনন, শহরের ভেতরের খাল, ছড়া, নালাগুলো সচল থাকলে বন্যার পানি আসলেও তা দ্রুত সরে যায়। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো সিলেটকেও আমরা এমনভাবে ধ্বংস করেছি, বন্যা ফুরালেও পানি ফুরায় না।

জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সিলেট শহরের ছড়া, নালাগুলো বন্ধ প্রায়। দখলে হারিয়ে গেছে অনেক খাল বা ছড়া। পানি সরার জায়গা না থাকলে তো পানি আটকেই থাকবে।

সিলেটকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ছড়া খনন, ছড়ার পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, ইউটাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নালানর্দমা প্রশস্তকরণসহ জলাবদ্ধতা নিরসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি কর্পোরেশন। চলতি বছর একই খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরও প্রায় ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। 

বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে বারবার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ বাঁধগুলো ঠিকমতো বানানো হয় না, মেরামত হয় না। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকৌশলী আর ঠিকাদারদের লাভ হয়। আবার প্রকল্প, আবার বরাদ্দ, আবার কমিশন, আবার লুটপাট।

সম্প্রতি ৩০০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরমা নদীর নগর অংশ খননে খরচ করছে ৫০ কোটি টাকা। এতকিছুর পরও কেন বারবার বন্যায় সিলেট শহর ডুবে যায়, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বরং জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যা হোক আর বৃষ্টি; পানি একবার আসলে আর যেতে চায় না।

এই যে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তারপরও সিলেট বারবার বন্যার পানিতে ডুবে যায় কেন? এর উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। উত্তরটা সহজ, কাজটা ঠিকমতো হয়নি। টাকাটা আসলে জলে গেছে। ১৯৮৮ সালের পর ঢাকা শহরে তো আর পানি ঢুকতে পারেনি। কারণ কাজটা ঠিকমতো হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উপকূল এলাকার অনেক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে বারবার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ বাঁধগুলো ঠিকমতো বানানো হয় না, মেরামত হয় না। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকৌশলী আর ঠিকাদারদের লাভ হয়। আবার প্রকল্প, আবার বরাদ্দ, আবার কমিশন, আবার লুটপাট।

সিলেটবাসীর ধারণা, সিলেটে বন্যা ও জলাবদ্ধতা ঠেকাতে যে হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে, তাও তেমন কোনো দুর্নীতির চক্রে আটকে গেছে। এখন নিশ্চয়ই আবার প্রকল্প নেওয়া হবে, আবার বরাদ্দ হবে, কাজ হবে। কিন্তু বন্যা ঠেকানো যাবে না।

ঈদ শেষ হলেও ঈদের আনন্দে সারাদেশের মানুষ, সিলেটবাসীর দুর্ভোগ যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা চাই, সুরমা-কুশিয়ারা সময়মতো খনন করা হোক; নগরীর ভেতরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখা হোক। যাতে বন্যা-বৃষ্টি যাই আসুক, দুর্ভোগটা যেন না হয়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ