ছবি : সংগৃহীত

মানুষকে বিনোদন দেবো। এটা যখনই মুখ্য হয়ে যায়, তখন সাধারণ-মানুষের আনন্দই হয় আসল। তখন ‘আর্ট’ বিষয়টা হয় গৌণ। কারণ বিনোদন দেওয়া এক ধরনের কাজ, যাতে দর্শক মনোযোগী ও আগ্রহী হয়ে ওঠে। আনন্দ পায়।

মানুষ যখনই খাবার আর বাসস্থান নিশ্চিত করে, তখন গুহার ভেতরে আঁকাআঁকি করতে থাকে। এঁকে আনন্দ পায়। বিনোদন সেইসব অংকন চিত্রে মনোনিবেশ করতে থাকে। সহস্র বছরের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে। মানুষ বিনোদন পাবে সেই আকাঙ্ক্ষা হয় মৌলিক।

চার্লি চ্যাপলিনের যুগে নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। ছবিঘরে আবহসংগীত ব্যবহার করা হতো লাইভে। ১৯২৭ সালে চলচ্চিত্রে শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। শব্দের ব্যবহার যখন শুরু হলো, তখন নাটকে-সিনেমার চেহারা পাল্টে গেল।

সবাক যুগের আরম্ভকালে দর্শক বদলে গেল। সাউন্ড ডিজাইনে নির্মাতা অধিক মাত্রায় মনোযোগ দিতে লাগল। এরপর ডাবিং আসে। আসে 'ফলী'। আবহসংগীত। পরিচালক নাটক বা চলচ্চিত্রের সাউন্ড সিস্টেমে আলাদা করে খেয়াল করতে থাকেন।

১৯২৭ সালে শব্দ প্রয়োগ শুরু হয় ঠিকই, বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে এর ব্যবহার শুরু হয় আরও পরে। শব্দের ব্যবহার নাটক ও চলচ্চিত্রে যখন হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ, তখন দর্শকদের বিনোদন চাহিদা পাল্টাতে থাকে। আমাদের দেশের বিনোদন চিত্র বদলে যেতে থাকে ক্রমশ।

এই দেশে ষাটের দশকে মানুষ কেবলমাত্র বিনোদিত হতো ছবিঘরে এসে। মানুষ ছবি দেখতো হলে ঢুকে। টেলিভিশন ছিল না। আত্মীয়স্বজন নিয়ে শুধুমাত্র সিনেমা হলে এসে সময় ব্যয় করতো। স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে। সেজেগুজে। খাওয়া-দাওয়া সেরে।

আয়োজন করে ছবিঘরে যাওয়া। আনন্দ নিয়ে, কখনোবা অশ্রুসিক্ত হয়ে ফিরে আসতো মানুষ। তাও সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে তৃপ্ত হতো যখন হলগুলো চালু হলো। সপ্তায় একদিন বা দুইদিন খোলা থাকতো। দুইদিন কি তিনদিন মজা নিয়ে ছবি দেখা হতো। এখন সেই চেহারার বদল ঘটেছে। শহরতলী, গ্রামে প্রায় সবার ঘরে এখন টেলিভিশন। আছে মোবাইল ফোন। টিভিকেন্দ্রিক বিনোদন।

মাঠগুলো ভূমি দস্যুদের কবলে পড়ে দখল হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা মাঠের সংকটে খেলাধুলা করতে পারে না। বিনোদন চাহিদা পূরণ হয় না। সিনেমা হল নেই। হলে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগও এখন কমেছে। একসময় অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল, তা আর নেই।

এখন হাতেগোনা কিছু 'ভিউ' সর্বস্ব অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে কাজ হচ্ছে। মাথায় থাকে না দর্শক পছন্দ। বাণিজ্যটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়....

ভরসা শুধুই টিভি। ছোট থেকে বড় মাপের টিভি। আর ভরসা কেবলই ডিস টিভি চ্যানেলগুলো। আনন্দ নেয় দর্শক। আগে ছিল একটি চ্যানেল। মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান দেখে আনন্দিত হতো। এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি চ্যানেলে হয় অনুষ্ঠানের আয়োজন। তাতে বিনোদন চাহিদা পূরণ হয় কয়জনের?

নিউজ চ্যানেল কমপক্ষে পাঁচ-ছয়টা। সাধারণ পত্রিকা পড়ার খরচ বহন করতে পারে না অনেকে। সরাসরি চ্যানেলগুলো দেখে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করে। উপভোগ্য অনুষ্ঠান দেখে আনন্দিত হয় কখনো কখনো।

দর্শকশ্রোতা পছন্দ করে মোবাইলের ইউটিউব অনুষ্ঠান। দোকানে-কাজে বসে দেখে ইউটিউবের ভিডিও। বেনিয়া নিয়ন্ত্রিত প্রযোজকদের দখলে চলে গেছে বিনোদন জগৎ। নাটকগুলো দেখানো হয় বড় অংকে। বাজেট বাড়ে।

একসময় বিটিভিতে একটি নাটকে খরচ হতো সর্বসাকুল্যে পাঁচ লাখ টাকা। পাঁচ-ছয়দিনে শুটিং করে তৈরি হতো। ওইসব কাজ দর্শক পছন্দের কারণ থাকতো।

এখন হাতেগোনা কিছু 'ভিউ' সর্বস্ব অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে কাজ হচ্ছে। মাথায় থাকে না দর্শক পছন্দ। বাণিজ্যটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। 'খাওয়া'টা দেখে প্রযোজক।

ঢাকাই ছবিতে যেমনটি ঘটেছিল। বিদায় নিয়েছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত প্রমুখরা। এসেছিলেন ঝন্টু-মন্টু। এসেছিল কপি-পেস্ট করা নির্মাতা। এসেছিল নকল, অশ্লীল সব নির্মাতা। এতে সিনেমা হলের সংখ্যা কমেছে। দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ছবিঘর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় দর্শকের বিনোদনের জায়গা সীমিত আকার নিলো। ইউটিউব, অ্যাপ, টিকটক-এ মানুষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। নিচ্ছে আনন্দ। তা কতটা ভালো হচ্ছে, বিতর্ক থাকলেও এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।

...বিদায় নিয়েছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত প্রমুখরা। এসেছিলেন ঝন্টু-মন্টু। এসেছিল কপি-পেস্ট করা নির্মাতা। এসেছিল নকল, অশ্লীল সব নির্মাতা। এতে সিনেমা হলের সংখ্যা কমেছে। দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

'ভিউ' সমৃদ্ধ পারফর্ম করবেন। পরিচালক বিষয় নয়। গল্প বিষয় নয়। একজন সেলিম আল দীন, আবুল হায়াত বিষয় নয়। বিষয় নয় হুমায়ূন ফরীদি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আফজাল হোসেন। বিষয় নয় চিত্রগ্রাহক। সম্পাদক। আবহসংগীত নির্দেশনা।

বাস্তবতা হচ্ছে দর্শক যেখানে ছুটবে, লগ্নি হবে সেইখানটায়। বিনোদনের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে যখন, তখন একজন উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেনের জন্ম হবে না। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক ক্রমশ হারিয়ে যাবেন। এই দেশে জন্মেছিলেন রাজ্জাক, আলমগীর, ববিতা। এখন সবেধন নীলমণি শাকিব খান।

আগে ছবি হতো তিরিশ-চল্লিশ দিন। সেলুলয়েড ফিল্মে কাজ হতো। এখন হয় ডিজিটাল ক্যামেরায়। তাতে ব্যয় কমে যাওয়ার কথা।

কিন্তু এখন ছবি হয় পনেরো-কুড়ি দিনে হলেও খরচ গুণতে হচ্ছে আশি-নব্বই লাখ। শাকিব খান জাতীয় ছবি হলে খরচ বাড়ে দ্বিগুণের বেশি।

দর্শক পছন্দের কারণ না ঘটলে মুখ থুবড়ে পড়ে। হলগুলোয় দর্শক টানতে না পারলে পুঁজি ওঠে না। যেমনটি লিখেছি, সিনেমা হলের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে চল্লিশ-পঞ্চাশে। আগে সেই সংখ্যা ছিল সাত-আটশো। হলের সংখ্যা কমছে। মাঠের সংখ্যাও।

প্রজন্ম আসক্ত হচ্ছে নেশায়। বিপজ্জনক হলেও এটাই বাস্তবতা। রাজনীতি বিমুখ দর্শক আনন্দ নিচ্ছে ইউটিউবে। নেটফ্লিক্স, হইচই, চরকিতে। আছে বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। মূলত দর্শকরাও তেমন কিছু দেখে না, একাগ্র নয় কিছুতেই।

সাম্প্রতিক ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হয় ঠিক, আনন্দিতও হয়। ঈদ প্রোগ্রাম মাথায় নিয়ে টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয় যা, তাতে কি দর্শক বিনোদিত হয় সেইভাবে? নেই বাংলা ছবির দর্শক।

আছে জিটিভি। স্টার জলসা। সনি। অথচ পশ্চিম বাংলাতেও হলের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, বাড়ছে নামকরা পরিচালক। একজন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গাঙ্গুলী দারুণ সব ছবি করে আন্দোলিত করছেন। পাশাপাশি দর্শকনন্দিত হচ্ছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

এমনকি পাকিস্তানের দিকে তাকানো যেতে পারে। ওখানে যেমন মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে, সিনেমা হলের সংখ্যাও বাড়ছে।

বাজেট বাড়ছে। আমাদের দেশে যেমন সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পায় ইংরেজি ভাষার ছবি, হিন্দি ছবি। পাকিস্তানের দর্শকরাও বিনোদিত হয় ওইসব ছবি দেখে। এখানে ভারত কি পাকিস্তান বলে বিষয় না।

অরুণ চৌধুরী ।। চলচ্চিত্র পরিচালক