মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং আগামীর বাংলাদেশ
মানুষ সামাজিক এবং মানবিক জীব। পৃথিবীতে প্রভু মানব সমাজকে তার প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যারা কি না প্রভুর একত্ববাদ হক বাতিলের ফারাক হক্কুল্লাহ্ এবং হক্কুল ইবাদের সফল সমাপনের মাঝেই স্রষ্টার নৈকট্য অন্বেষণ করবে। আর এসবে জ্বালানি হিসেবে প্রেষণা যোগায় শিক্ষা। পবিত্র কুরআন মাজীদের প্রথম বাণীই হলো পড় তোমার প্রভুর নামে। যা সত্যিই ভাববার বিষয়! মহানবির জামানায় মানবিকতার উৎকর্ষ ছিল চরমে। মসজিদ আল্লাহর ঘর। মসজিদকে ঘিরে শিক্ষা কার্যক্রমের গোড়াপত্তনে মসজিদে নববীর 'মাদ্রাসারই সুফ্ফা' এক বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে।
মসজিদ পবিত্র স্থান। যেখানটায় সমবেত হয়ে মানুষ সাম্য সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব সহনশীলতা নৈতিকতা এবং সামাজিকতা চর্চার সুবর্ণ সুযোগ পায়। কেননা মহানবি (সা:) বলেছেন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান হলো মসজিদ। মসজিদের নয়নাভিরাম অবকাঠামো এবং স্বর্গীয় আভা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের উপযোগী নাগরিক সৃজনে পবিত্র দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আসছে। আমাদের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদেও অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু হওয়া মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদা, আব্বাসীয় এবং উমাইয়া শাসনামলেও বিস্তৃত হয়। এসবের ফলেই নৈতিক মানবিক এবং আধুনিক চিন্তাশীল হিসেবে আল জাবির, ইবনেসিনা এবং ইবনে খলদুনরা জ্ঞান বিজ্ঞানের আধুনিক শাখায় মানবকল্যাণে ঈর্ষণীয় সফলতা দেখায়। এ উপমহাদেশে ও মুসলিম শাসকরা মক্তব এবং মসজিদভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক এবং কুরআন শিক্ষার রেওয়াজ চালু এবং সম্প্রসারণে মনোযোগী ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ ইসলামি কৃষ্টি কালচার তমুদ্দনের বিকাশ এবং লালনের মানসে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যাত্রা শুরু হয়। আর এ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গণমুখী সফল এবং সার্থক প্রকল্প হলো মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম। যা পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় অসহায় অভাবী দুস্থ এবং ঝরে যাওয়া রোধ কল্পে জ্ঞানের বাতিঘর হিসেবে রোশনাই ছড়াচ্ছে। এটি গরিবের কিন্ডারগার্টেন হিসেবে ও সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। সবার জন্য শিক্ষা এ স্লোগানকে ধারণ করে প্রকল্পের নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকরা নীরবে আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্য স্থিতিশীল এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজের মুক্তিফৌজ হিসেবে অসাধারণ কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। যা দেশ গঠনের মৌলিক ভিত্তি যৌক্তিক এবং কাঙ্ক্ষিত নাগরিক উপহারে অবদান রাখছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয় বাস্তবতা। আমরা সে পথেই হাঁটছি। সবার অংশগ্রহণ এবং সম্মিলিত প্রয়াসেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব। এখানটায় মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম এ যাত্রায় সরব উপস্থিতি স্মার্ট নাগরিক গঠনে নিয়ামক হাতিয়ার হতে পারে। ফলত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এসব কেন জরুরি? এ যেন কোটি টাকার জিজ্ঞাসা!
আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াসে জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০ এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি জীবনে নৈতিক মানবিক সাংস্কৃতিক সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্দীপনা আনয়ন। মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু থেকে আজ অবধি এ লক্ষ্যার্জনে সারা দেশে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার সার্বজনীন আবহ তৈরি হচ্ছে । রূপকল্প ২০৪১ এ বলা আছে বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা। দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। ২০৪১ এ প্রাথমিক স্কুলে ঝরে পড়ার হার শূন্যের ঘরে আনার অভিলাষ ব্যক্ত করা হয়েছে। যেখানটায় মসজিদ ভিত্তিক এ কার্যক্রমের সফলতার হার শতভাগ। প্রাথমিকে ভর্তিতে প্রকল্পের শিক্ষার্থীর হার আশা ব্যঞ্জন। এসডিজির কারণে এ দেশ ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষা। নানা জরীপ এবং বিশ্লেষণে দেখা যায় ইমাম মুয়াজ্জিনদের গণমুখী সম্পৃক্ততায় মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের পথ সহজ হচ্ছে।
সমাজে বাসোপযোগী কর্মক্ষম নাগরিক তৈরিতে এ প্রকল্প নানা আয়োজনের পসরা সাজিয়েছে। নৈতিকতাকে ভিত্তি ধরেই এসব আবর্তিত। ফলে দেখা যায় এ কার্যক্রমের ধরন এবং উদ্দেশ্যকে ধারণ করে সারাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যা আলীয়া কওমি এবং স্কুল শিক্ষা সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। সিলেটের উদ্দীপন হাই স্কুল এবং জামেয়া দারুল ইসলাম এ ধারার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রশ্নাতীত ভাবে বলা যায় এ প্রকল্প স্মার্ট বাংলাদেশের অহংকার।বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রত্যক্ষ সহযোগী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ কার্যক্রম। মন্ত্রিপরিষদসহ ৪৯ টি মন্ত্রণালয়ের নানা দিক নির্দেশনা প্রচার ও প্রসারে শিক্ষকরা নিয়ত নিয়োজিত। যা কিনা বিনা অর্থ ব্যয়, বিলবোর্ড ব্যতীত এবং প্যান্ডেল সাউন্ড সিস্টেমের বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই সফল করা সম্ভব হচ্ছে।
নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। গেজেট নির্ভরতা তরুণ মনে আত্মকেন্দ্রিকতাকে বিকশিত করছে। সামাজিক সম্পর্কের নানা উপকরণের সাথে প্রজন্মের যোগাযোগে অনীহা। ভার্চুয়াল জগতেই বেশি ব্যস্ত থাকছে। এমন পরিস্থিতিতে বয়স্ক শিক্ষা কুরআন শিক্ষা প্রাক-প্রাথমিকে পারস্পরিক মেলামেশার দারুণ সুযোগ তৈরি করছে। সামাজিক এবং নৈতিকতা সম্পন্ন জীব হিসেবে গড়ে উঠতে যা সহায়ক ভূমিকা রাখবে। মানুষ সামাজিক জীব যে মানুষ সমাজে বসবাস করে না সে হয় পশু না হয় দেবতা (এরিস্টটল) এমন বাস্তবতায় শিশু এবং বয়স্ক শিক্ষা সবার মাঝে সামাজিকীকরণের বীজ বপন করছে। কেননা সামাজিক কারণ হলো জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। সুস্থ এবং স্বাভাবিক সামাজিকীকরণের উপর নির্ভর করে আগামীর বাংলাদেশ। এখানটায় ইমাম মুয়াজ্জিনগণ নৈতিকতা বন্ধন সামাজিক প্রথা রীতি আইন মহব্বত মূল্যবোধ মনোভাব এসব প্রপঞ্চ চর্চার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মানব সম্পদ তৈরিতে কাজ করছে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ইমাম মুয়াজ্জিনগণ এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে কিছুটা হলে ও রেহাই পাচ্ছে। যা কিনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রথম লক্ষ্য এবং রূপকল্প ৪১ দারিদ্র্যতাকে অতীতের বিষয় মনে করা হবে আর এ লক্ষ্যেই এ প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে।
মসজিদ ভিত্তিক কার্যক্রমের কেন্দ্রগুলো দৈব দুর্বিপাকে মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগাম ঘোষণা, ঘূর্ণিঝড় এককালীন করণীয়, বন্যায় নানা পদের তথ্য সরবরাহ, করোনাকালীন লকডাউন বাস্তবায়ন, করোনা রোগীদের দাফন, হাত ধোয়া এবং মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণে নানা কৌশল গ্রহণ করেছে। যা সরকারের চলমান কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি সরকারের সবচেয়ে সফল কর্মসূচি। টিকাদানের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু মৃত্যুহার ডায়রিয়া হুপিং কাশি টাইফয়েড সহ নানা ব্যাধির নিরাময় হাতের নাগালে এসেছে। এসবের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। এ কার্যক্রমের প্রচার টিকাদান কেন্দ্রে মানুষের গমনের তথ্য এবং নিয়মিত ঘোষণা দিয়ে ইমাম মোয়াজ্জিনরা সহযোগিতা করছেন। ভিটামিন এ ক্যাপসুল এবং ক্রিমিনাশক ট্যাবলেটের ব্যবহার নিশ্চিতেও এ প্রকল্পের শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় স্বাস্থ্য সচেতনতার ৮৪ শতাংশ অবদান হচ্ছে মসজিদের ইমাম এবং মুয়াজ্জিনদের।
মসজিদভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম স্বপ্নিল বাংলাদেশের যুগান্তকারী প্রকল্প। গুজব রোধ, জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা এবং বিস্তার রোধে করণীয় মানবিক সাহায্য, সামাজিক অসংগতি রোধ, মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচার দুর্নীতি নিরোধে বয়ান নারী নির্যাতনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মসজিদের অবকাঠামোর যৌক্তিক ব্যবহারসহ নানারকম কর্মের সাথে মসজিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সরকারের নীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা,টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন সহ অসংখ্য কাজে এ প্রকল্পের জনবল সংশ্লিষ্ট। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক এখন সময়ের দাবি। যার সফল রূপায়ণে এমন এক জাতি চাই যারা সামগ্রিকভাবে সুস্থ থাকবে বিশেষত শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিকভাবে। যা আগামীর সোনারবাংলা বিনির্মাণে নিয়ামক শক্তি হিসেবে রসদ যোগাবে।
ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল ।। অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়