ছবি : সংগৃহীত

আপাতদৃষ্টিতে ঈদ ধর্মীয় উৎসব। যদিও অতিরঞ্জিত শব্দ ‘আত্মশুদ্ধির’ ভারে ঈদুল আযহা সবসময় কিছুটা ন্যুজ থাকে। তবে গৎবাঁধা প্রতিদিনকার যাপনে ঈদ সত্যিকার অর্থেই অবাক আলোর বিচ্ছুরণ। ঈদ উৎসব একাধারে আনন্দ, ক্ষমা ও উদযাপনের সংমিশ্রণ।

আরেকটু বাড়িয়ে ঈদের গুঢ় অর্থ খুঁজতে গেলে—ঈদ হলো সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য শব্দ দুটোর ধর্মকেন্দ্রিক বিশ্লেষণে যাবো না।

সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য শুধু নির্দিষ্ট একটি জাতির মধ্যে না, বরং জাতপাত, কালোধলো, শিক্ষা, শ্রেণিবৈষম্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিশ্বমানবতার। পৃথিবীর ও প্রকৃতির জন্য যা কিছু কল্যাণকর তাই স্রষ্টার দেখানো পথ। তাই উদযাপনের অংশীদারও সবাই।

যেহেতু উৎসব তাই ঈদের কিছু মৌলিক আচার অনুষ্ঠান থাকে। যার মধ্য দিয়ে আনন্দ, ক্ষমা ও উদযাপন এই তিনটি উপাদান খুব সুন্দর করে সম্পন্ন করা যায়। বৈশ্বিক সংযোগের যে দুনিয়ায় এখন আমাদের বাস সেইখানে ভাবনার জগৎকে সংকুচিত করার সুযোগ নেই।

অথবা বলা যায় নিজের সংকুচিত ভাবনার দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করা এখন খুব কঠিন! তারপরেও উৎসব বাস্তবতা নিয়ে সমাজে নানান অসঙ্গতি আছে, থাকবে। পরম্পরার মতো হয়তো সেইসব আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। যেমন ধানের সাথে দুই চারটা চিটাকে আমরা ভবিতব্য ভেবে নেই।

ঈদ আকাঙ্ক্ষিত। কত কারণেই না আমরা ঈদকে চাই! ঈদ আছে বলেই আমরা ডেডলাইনের তারিখ উল্লেখ না করেই বলতে পারি আন্দোলন ঈদের পরে হবে। ঈদের কারণেই সরকারি দল ও বিরোধী দলীয় নেতাদের একে অন্যের মুখ দেখাদেখিতে কোনো অজুহাতের প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ। প্রতিবেশী ঘর অন্য ধর্মাবলম্বীর হলে তাদের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ থেকে বিরত থাকা আমাদের ধর্মীয় ও মানবিক শিক্ষা।

বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মন কষাকষিও এক তুড়িতে ঘুচিয়ে দেওয়া যাবে। শুধু কাউকে কখনোই বলা হয়নি আমার একটা ঈদহীনতার কথা। সেই শিশুকাল থেকে আমি তীব্র বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছি। ছোট ছিলাম, তারচেয়েও বড় ব্যাপার হলো ঘটনাটা যে সময়ের, তার আশেপাশে ঈদ পার্বণ ছিল না। থাকলে ঠিকই আড়ি কাট্টি ঘুচে যেত।

এখনো সেইদিনের দৃশ্য চোখের পাতায় ভর করে। হঠাৎ একদিন জানলাম বাবার পোস্টিং হয়েছে অন্য শহরে। বুঝলাম স্কুলের বন্ধুদের সাথে আমার বিচ্ছেদপর্ব সন্নিকটে। লাজু ও সাজুর সাথে আমার আড়ি চলছিল। কথা বন্ধ। কী করে কথা বলা যায় ভাবছিলাম কিন্তু ছোট মাথায় কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না।

শহর ছাড়ার দিন যখন গাড়িতে উঠতে যাবো আমি তাকিয়ে ছিলাম লাজু ও সাজুর দিকে, তারাও আমার দিকে। চোখ ছলছল সবার কিন্তু কেউ কথা বলতে পারিনি। ঈদ হাসতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়, ত্যাগের মহিমা শেখায়। শৈশবের বিষাদময় সেই আড়ি আর কাট্টিকে আমি এখনো ভীষণ ভয় পাই। কখনো আর দেখা না হওয়ার ভয়।

ঈদ অপেক্ষার। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ। প্রতিবেশী ঘর অন্য ধর্মাবলম্বীর হলে তাদের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ থেকে বিরত থাকা আমাদের ধর্মীয় ও মানবিক শিক্ষা। এক টেবিলে খেতে বসলে অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুর প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই সেইখানে খাবারের মেন্যু নির্বাচন করা হয়।

পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার এই জায়গাটা পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা। তবে এটা তখনই তৈরি হয় যখন একজন মানুষ সব ধর্মকে সম্মান করার পাশাপাশি নিজের ধর্মীয় উৎসবকে সবার সাথে ভাগাভাগি করার মানসিকতা রাখে। যদিও মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা। সেই চেষ্টা যে করে না ঢালাওভাবে তা অস্বীকারও করি না।

তবে সব চেষ্টা জনহিতকর নয় এটা মানুষ একসময় জেনে যাবে। আরও ভালোভাবে বললে বলা উচিত মানুষ আসলে একসময় শিখে যাবে। প্রজন্ম বিরাট একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড পার করছে এটা সত্যি। কিছু বিষয়ে তাদের বোধের অসঙ্গতি আছে, কিছু বিষয়ে সংস্কার এসে চোখ রাঙায় আর অবশ্যই বাকিটা হলো রাজনৈতিক।

বোধের অসঙ্গতি ও সংস্কারকে ঘষামাজা করে উন্নয়ন ঘটানো যায় কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনের জায়গায় মানুষ অনেকখানি অসহায়। ইতিহাস পরিক্রমায় সময় তার অভিযোজন ক্ষমতা বদলায়। ক্রমান্বয়ে আরও টেকসই হয়। সুতরাং আমাদের জেনারেশন জেড (Gen Z) ও জেনারেশন আলফা প্রজন্ম বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হবে এবং তাদের অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হবে এমন আশা করতেই পারি। 

বোধের অসঙ্গতি ও সংস্কারকে ঘষামাজা করে উন্নয়ন ঘটানো যায় কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনের জায়গায় মানুষ অনেকখানি অসহায়। ইতিহাস পরিক্রমায় সময় তার অভিযোজন ক্ষমতা বদলায়। ক্রমান্বয়ে আরও টেকসই হয়।

ঈদ যখন আসি আসি করে তখন প্রায় সবারই একটা সাধারণ প্রশ্ন থাকে। কোথায় ঈদ করবেন? সহজ ও সুন্দর প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করতে যেমন ভালো লাগে, শুনতেও তেমন ভালো লাগে, উত্তর দিতেও ভালো লাগে। তবে আরও একটা বিষয় আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয় যখন অন্য ধর্মাবলম্বীদের দেখি ঈদ উপলক্ষে তাদের মুসলিম বন্ধু/কলিগ/প্রিয়জনদের ভালোবেসে ঈদ উপহার দিতে। সাথে সাথে কয়েকটা শব্দ আমার মনে পড়ে যায়—সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও প্রগতি। শব্দগুলোর মধ্যে দারুণ শক্তি আছে।

আমি শিখলাম অন্য ধর্মের উৎসবে প্রিয়জনদের ভালোবেসে উপহার দেওয়া যায়। সারাবছরের স্বাভাবিক আদানপ্রদানের চেয়ে এটা অন্য মাত্রার বিষয়। কারণটা সেই ট্রানজিশন পিরিয়ডের উত্তরণ কী! অপারগ হয়ে যেটা আমরা অলৌকিক সময়ের ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম! যে রাজনৈতিক দর্শন মাত্র গুটিকয়েক মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে বলে ভ্রম হয়েছিল!

ঈদ মানে হাসিমুখ। আমার বাসার গলিতে সবসময় কয়েকজন রিকশাচালক বসে থাকেন। তাদের মধ্যে বয়স্ক মানুষও আছেন। দীর্ঘদিন গলির মুখে দেখতে দেখে চেনা পরিচিত হয়ে গেছেন। সেইদিন ভাড়াটা দিতেই বয়স্ক রিকশাচালক চাচা আমার কাছে আবদার করলেন মা, আমার জন্য কিন্তু মাংস রাইখেন। আমি বাড়ি থেকে এসে নেবো।

আমি খুব আনন্দের সাথে তাকে বললাম অবশ্যই রাখবো। আপনি এসে আমার বাসা থেকে নিয়ে যাবেন। আমি ঈদ করতে গ্রামে যাবো এবং সেই বয়স্ক রিকশাচালক চাচার জন্য আমি মাংস বহন করে আনবো।

অন্যসময় চাইলে আমি হয়তো বিরক্ত হলেও হতে পারতাম। কিন্তু এখন সময়টা অন্য। ভাবতেই ঈদ ঈদ বাতাস বইছে চারদিক। এটাই হয়তো ঈদ আনন্দ।

ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড