ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ বেশ লম্বা সময় যাবৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করে আসছে। একটি দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৫৯) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪, ৬৫>) অতিক্রম করে, তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের উদ্ভব হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফলে দেশের কর্মক্ষম তরুণ শক্তিশালী জনগোষ্ঠী কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন খাতে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে যুব শ্রমশক্তির (১৫-২৯ বছর বয়সী) সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখের বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের এই বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (১৫-২৪ বছর বয়সী) প্রায় ৩৯.৮৮ শতাংশ বর্তমানে কোনো কর্মে নিয়োজিত নেই।

নারীদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত না থাকার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের জনগণ যখন মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তরুণদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, দেশের শ্রমবাজারের তাদের অংশগ্রহণ না থাকা অর্থনীতির জন্য কোনো সুসংবাদ বয়ে আনে না।

এই সংকট আরও গভীরতর হয় যখন দেখা যায়, চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে আগ্রহী শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ উচ্চশিক্ষা শেষ করার পরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে অনুপযুক্ত ও কম মজুরির কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায়, বেকারত্ব শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং জাতীয় উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দিচ্ছে।

নির্বাচিত সরকারের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘স্মার্ট বাংলাদেশ উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। নির্বাচনের পরে নতুন বাজেট যখন ঘোষণা করা হলো, তখন দেশের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক বেকারত্বের হার প্রায় ৩.৫১ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ৬ জুন ২০২৪ মাননীয় অর্থমন্ত্রী সংসদে ৫৪তম বাজেট ঘোষণা করলেন।

এবারের বাজেটের আকার গত বছর থেকে প্রায় ৪.৬ শতাংশ বেড়ে ৭, ৯৭, ০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারের বাজেটেও দেশের সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম গোষ্ঠী তরুণদের কর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দক্ষতা উন্নয়নে কতটা লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ কীভাবে নিলেন, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

তরুণদের মধ্যে প্রায়ই যে কথা আলোচনা করতে দেখা যায় যে, দেশের পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই এবং সঠিক শিক্ষার পরিবেশ নেই। এই বাজেটে যেসব ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’। সেই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত প্রয়োজন।

শিক্ষাখাতের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী সব মিলিয়ে প্রায় ৯৪, ৭১১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২৭ শতাংশের কাছাকাছি। বাজেট বৃদ্ধি পেলেও তা এখনো জিডিপির ২ শতাংশের নিচে রয়েছে।

বাজেটে উল্লিখিত ‘তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ’ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। আমাদের দেশের শিক্ষাখাত এখনো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা মেটানোর মতো কারিগরি দক্ষতা জনগণের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শুধুমাত্র প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না, বরং তা সঠিকরূপে পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তরুণদের মধ্যে যুগোপযোগী বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ করাও জরুরি।

আমাদের দেশের শিক্ষাখাত এখনো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদা মেটানোর মতো কারিগরি দক্ষতা জনগণের মধ্যে তৈরি করতে পারেনি।

বাংলাদেশ খুব শিগগিরই নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বৈদেশিক বাজারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা কমে যাওয়া এবং প্রযুক্তিপণ্যের অগ্রগতি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।  এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার এবারও প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে প্রণোদনা, প্রযুক্তিপণ্য ক্রমে কর হ্রাস করেছেন।

তবে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও সঠিক ইকোসিস্টেমের অভাবের কারণে বাজেটের এই সুবিধা আমরা এখনো পুরোপুরি ভোগ করতে পারছি না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। দেশে বেশ কয়েকটি তথ্য প্রযুক্তি পার্ক নির্মিত হয়েছে, তবে প্রায়ই বিভিন্ন খবরের মাধ্যমে দেখতে পাই যে, তথ্য প্রযুক্তি পার্কের সঠিক ব্যবহার আমরা করে উঠতে পারছি না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অগ্রাধিকার বিবেচনায় খাতওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বাজেটের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। তাই সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের নিজ নিজ খাতের উন্নয়নে আরও আগ্রহী হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তবে এই পদক্ষেপগুলোর গণ্ডি আরও সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে আরও প্রচারণা চালানো ও গ্রামাঞ্চলেও এই সব দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

তবে সরকারের এই বাজেটে তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রদানের প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী আগের তুলনায় এখন অনেক শিক্ষিত এবং তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে তাদের চাওয়া পাওয়া অনেক। যেহেতু দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তাই তারা দেশের কর্ম পরিবেশের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মান আশা করেন।

ভালো চাকরি, সম্মানজনক বেতন ও কর্মের নিশ্চয়তার আশায় হাজার হাজার তরুণ সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছেন। এক সরকারি চাকরির জন্য তারা তাদের যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার করে ফেলছেন, তবু অনেকেই সেই অধরা স্বপ্নের দেখা পাচ্ছেন না। বাজেট সামাজিক সুরক্ষার কথা বললেও তরুণদের জন্য আলাদা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কিংবা তাদের চাকরি বাজার আরও প্রসারণে কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। পাশাপাশি, যুবদের কল্যাণে বাজেটে পূর্ববর্তী বিভিন্ন কর্মসূচির কথা বলা হলেও আদতে তা ভবিষ্যতেও দেশের বিপুল শিক্ষিত তরুণের বেকারত্ব নিরসনে কাজ করবে কি না, তা ভাবনার বিষয়।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তরুণদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। সঠিক শিক্ষা, দিকনির্দেশনার অভাব, কর্মসংস্থান না থাকার কারণে প্রতিনিয়ত আমরা কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, আত্মহত্যার মতো খবরের মুখোমুখি হই। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের প্রতি সামান্য গুরুত্ব তরুণদের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া ও বিভিন্ন ধরনের মাদকাসক্তি থেকে তরুণদের বিরত রাখার ক্ষেত্রে আলাদা বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। এতে করে তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ ও কর্মে তাদের সঠিক অংশগ্রহণ বাড়ানো যেত।

বাজেটে বারবার দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বলা হলেও তা অর্জনে এবং তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার কথা বলা হয়নি। হয়তো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকতেই পারে, তবে এই বাজেট তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া ও তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে আলোক দিশারী হয়ে উঠতে পারতো।

আমাদের শুধু একটাই আশা, দেশের তরুণরা যেন দেশেই থেকে নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারে এবং তাদের যৌবনের সঠিক সময় কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। আশা করি, সংশোধিত বাজেট ও সামনের বাজেট আরও তরুণ-বান্ধব হবে ও সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে আরও কয়েকধাপ এগিয়ে যাবেন।

দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) চিত্র তুলে ধরে, এই বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৬৫ দশমিক ০৮ শতাংশ যা সংখ্যার হিসেবে প্রায় ১১ কোটি।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায় এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যা (শূন্য থেকে ১৪ ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী) হ্রাস পায়, তাহলে জনমিতির সুবিধা দেশটির অনুকূলে থাকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। এই তালিকায় আছে হংকং, সিঙ্গাপুর তাইওয়ান, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো।

২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬,৯৮,২৮,৯১১ (যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮,১৭,৬৯,২৬৬, নারী ৮,৩৩,৮১,২২৬ ও অন্যান্য ৮,১২৪ জন) যা বিশ্বের মধ্যে ৮ম বৃহত্তম। ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার।

এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী যা সংখ্যার হিসেবে নামিবিয়া, বাহরাইন, কসোভোর মতো দেশের জনসংখ্যা থেকেও বেশি; তাদের কাজে লাগাতে না পারতে অর্থনৈতিক ক্ষতি বহন করতে হবে দেশকে এবং এতে সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হবে, অন্যদিকে সমাজে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বের সব প্রান্তে তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে যে এতদিন ধরে চলে আসা প্রচলিত ব্যবস্থাকে, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজ পর্যন্ত, আমূল বদলে দিচ্ছে এই শিল্পবিপ্লব। মানুষের জীবনমান এবং জীবনাচরণে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন—এবং তা সম্ভব হচ্ছে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে। এতে করে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসছে বর্তমান কর্ম ব্যবস্থায়, অর্থাৎ চাকরির বাজারে ঘটছে চতুর্থ শিল্পবিল্পবের মূল প্রতিফলন।

ভালো চাকরি, সম্মানজনক বেতন ও কর্মের নিশ্চয়তার আশায় হাজার হাজার তরুণ সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছেন। এক সরকারি চাকরির জন্য তারা তাদের যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পার করে ফেলছেন, তবু অনেকেই সেই অধরা স্বপ্নের দেখা পাচ্ছেন না।

উৎপাদন পদ্ধতিকে স্বয়ংক্রিয়করণ করার ফলে প্রচলিত জ্ঞান, দক্ষতা এবং কৌশলকে বাতিল করে প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান তার জায়গা করে নিচ্ছে। বর্তমান সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চতুর্থ শিল্পবিল্পবের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে এখনো এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি দক্ষতা বৃদ্ধি দেখা যায় না, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চতুর্থ শিল্প বিল্পবের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা দেওয়া থাকলেও এর বাইরে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী এখনো দ্বিধাগ্রস্ত থাকে।

কর্মক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ধীরে ধীরে বর্তমানে প্রচলিত বেশিরভাগ চাকরি অথবা কর্মসংস্থানের বিলোপ ঘটছে, যার প্রভাবে এই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে না পারা প্রায় সব কর্মজীবী তাদের চাকরি হারাচ্ছেন। একশ শতকের গ্লোবাল ভিলেজের অংশ বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, স্রেফ সরকারি চাকরির পেছেনে ছুটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ-তরুণী তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অপচয় করছেন এতে করে যেমন নিজেরা ব্যক্তিগত দক্ষতা তৈরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ঠিক একইভাবে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে উৎপাদনশীলতা থেকে।

জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের অভাব, আদিম ও সনাতনী কৃষিব্যবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মন্থর অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার, মহিলাদের কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি কারণে দেশে প্রতি বছর বেকারের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

আরেকটি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ৪৭ ভাগ শিক্ষার্থীই বেকার থাকছেন, যেখানে ভারতে এই হার মাত্র ৩৩ ভাগ, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ আর শ্রীলঙ্কায় মাত্র ৭.৮ ভাগ—আমাদের প্রতিবেশী দেশ এগুলোর দিকে তাকালে আমাদের চিত্র উপলব্ধি করা যায়।

বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনাও দেশের বর্তমান বেকার পরিস্থিতির জন্য দায়ী, করোনা মহামারি এবং এর ঠিক পরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে এই যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে দেশের চাকরির বাজারে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে স্রেফ ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ২৫-৩০ শতাংশ মূলধন হারিয়েছে (প্রথম আলো, ০২ জুন ২০২৪) এবং এর যোগ হয়েছে কাঁচামাল আমদানি শুল্ক, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে অতিরিক্ত খরচ—যার ফলশ্রুতিতে শিল্প খাতে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে।

দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৩৪৮ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল। আর গত বছর এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছর এফডিআই কম এসেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৪৮ কোটি ডলার।

অন্যদিকে, এই বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক ফর বাংলাদেশ প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি নতুন করে চরম দারিদ্র্য সীমায় পড়বে। অন্যদিকে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছাবে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশে, যা বেসরকারি খাতকে আরও দুর্বল এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

আশার কথা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণের বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে নিরসনে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই বিষয়ে চলতি বছরের মার্চে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।’

এই আশা পুনরায় ব্যক্ত করে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘বর্তমানকালে নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো ৫ বছরের মধ্যে সকলের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। গত জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইএলও সোশাল জাস্টিস সামিটে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, কর্মক্ষেত্রে নারী ও তরুণদের মেধা ও কর্মশক্তিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হবে।’

বাজেট আলোচনায় মাননীয় মন্ত্রী উল্লেখ করেন, চতুর্থ শিল্পবিল্পবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং বেকার সমস্যা রোধে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ স্মার্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে সরকার। এর মধ্যে এই খাতে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০৩১ সালের মধ্যে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিতে সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, রোবোটিকস, সেমি-কন্ডাক্টর, ইলেকট্রিক ভেহিকেল, স্পেস ও জিওস্পেসিয়াল প্রযুক্তিসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি-ভিত্তিক গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।

আইসিটি খাতের রপ্তানির পরিমাণ আগামী ৫ বছরের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হবে। এই খাতের অংশীজনদের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে সব সেক্টরে স্মার্ট হয়ে ওঠার মানদণ্ড তৈরির পাশাপাশি তৃণমূলসহ দেশব্যাপী উদ্ভাবন ও গবেষণা উৎসাহিত করতে পরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’

দেশের কর্মক্ষম শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারটি উঠে আসে মাননীয় মন্ত্রীর এবারের বাজেট আলোচনায়। এই লক্ষ্যে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৪৬৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ২১৪ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ২৪৮ কোটি লাখ টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৪৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে ৩৭৩ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অথবা এসডিজি বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন নেটওয়ার্কের (এসডিএসএন) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের এগিয়ে থাকা তিনটি দেশের মধ্যে একটি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এসডিজির ২০২৩ সালের মূল্যায়ন সূচকে ২০২২ সালের তুলনায় ১৬৬ দেশের মধ্যে তিন ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১০১। তালিকায় ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১১২ ও ১২৮তম। এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের অভীষ্ট অর্জনের সার্বিক স্কোর একশর মধ্যে ৬৫ দশমিক ৯।

এসডিজিতে স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ৮ম অভীষ্ট হিসেবে শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নির্ধারণ করা হয়েছে। অভীষ্ট-৮ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের যুবসমাজ ও অসমর্থ (প্রতিবন্ধী) জনগোষ্ঠীসহ সব নারী ও পুরুষের জন্য পূর্ণকালীন উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ও শোভন কর্ম সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য অর্জন এবং সমপরিমাণ/সমমর্যাদার কাজের জন্য সমান মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের আশা দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মোপযোগী করে তোলা এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিক উপায়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্তে এবারের বাজেটে উল্লেখ করা রূপরেখা এবং পরিকল্পনা গুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, যা বাংলাদেশকে একটি সুখী, সুন্দর এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করবে।  

ড. রুমানা হক ।। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, আর্ক ফাউন্ডেশন