ছবি : সংগৃহীত

সামষ্টিক অর্থনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো জাতীয় বাজেট। যেকোনো দেশের সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবছর সম্ভাব্য ব্যয় এবং আয়ের হিসাব প্রস্তুত করতে হয়, যাকে অর্থনীতির ভাষায় বাজেট বলা হয়ে থাকে। এই দেশে বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়।

সরকারি দল এবং তার সমর্থকেরা মোটাদাগে বাজেটকে ‘অসাধারণ’ বা ‘জনবান্ধব’ বলে আখ্যায়িত করলেও বিরোধী দলগুলো বাজেটকে সাধারণত ‘গণবিরোধী’, ‘অবাস্তব’ বা ‘গরিব মারার’ বাজেট বলে প্রত্যাখ্যান করে থাকে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী সংগঠন, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাজেটের ওপর মতামত দিতে দেখা যায়। কিন্তু এদেশে বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? তারা কি আদৌও বাজেট নিয়ে সচেতন বা উৎসাহী? এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি।

আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ি। সালটি সম্ভবত ২০০৩ হবে। একদিন বাজেট ঘোষণার পর আমরা ক্লাসের সবাই মিলে আমাদের এক সিনিয়র শিক্ষককে বাজেট নিয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করি। ঐ শিক্ষক তখন অনেকটা রসিকতা করে আমাদের বললেন, ‘দেখুন মশাই, আমাদের দেশে বাজেট হলো অনেকটা সার্কাসের মতো। আগেকার দিনে গ্রামেগঞ্জে যখন শীতকালে সার্কাসের আয়োজন করা হতো, তখন গ্রামের মানুষ সার্কাসের কয়েকদিন আগে ও পরে সার্কাস নিয়ে খুব উত্তেজনা দেখাত বা হইচই করত।

সপ্তাহখানেক পরে সবাই ঐ সার্কাসকে ভুলে গিয়ে আর হইচই করত না। ঠিক তদ্রূপভাবে আমাদের দেশে জাতীয় বাজেট হলো সার্কাসের মতো একটি বিষয়। বাজেট ঘোষণার আগে ও পরে কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজেট নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়। কয়েক সপ্তাহ পরে বাজেটের রেশ কেটে গেলে সাধারণ মানুষ আর বাজেট মনে রাখে না।’

এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট ততটা জনপ্রিয় কোনো বিষয় নয়। তাদের কাছে একটি ভালো বাজেটের সংজ্ঞা হলো, বাজেট তাদের ন্যায্য এবং সহনশীল মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারছে কি না।

অধিকাংশ গরিব, স্বল্প আয়ের মানুষ এবং মধ্যবিত্তের কাছে প্রত্যাশা হলো বাজেট ঘোষণার পর যাতে সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনশীল এবং ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু এদেশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজেটে কোনো ঘোষণা আসার আগ থেকেই বাজেটের অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ খুব বিপাকে পড়ে, যা আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখতে পাচ্ছি।

কোন কোন খাতে ব্যয় কমানো হবে তা তিনি স্পষ্ট করেননি। অর্থাৎ বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পেলেও তা থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই বললেই চলে।

এবার আসি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে। ৬ জুন ২০২৪, মহান জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যে আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট পেশ করলেন, যার মোট আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।

যেকোনো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান দুটো লক্ষ্য হলো দাম স্তর স্থিতিশীল রাখা এবং বেকারত্ব দূর করা বা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বাজেটের মাধ্যমে সরকার যদি সেই দুটো লক্ষ্য মোটামুটিভাবে অর্জন করতে পারে তাহলে উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঐ বাজেটকে আমরা জনবান্ধব বাজেট বলে থাকি।

এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি বেশ কয়েক বছর ধরে, আমাদের দেশে সরকার বাজেটের মাধ্যমে ঐ দুটো লক্ষ্য অর্জনে বেশ পিছিয়ে আছে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে বেশ সংযত ছিলেন।

চলতি বাজেটের তুলনায় মাত্র ৪.৬০ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা যা চলতি বছরের এডিপির তুলনায় মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সরকারের দুর্বল ও অদক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে চাপে আছে। দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ, ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলশ্রুতিতে ডলার সংকটের কারণে পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে।

মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ জনগণ খুব চাপে আছে। এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয় স্বীকার করে তা কমানোর বিষয়ে বেশকিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন।

যেমন ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা বা কমানো, অযৌক্তিক ব্যয় কমানো, কিছু খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো ইত্যাদি। কিন্তু কোন কোন খাতে ব্যয় কমানো হবে তা তিনি স্পষ্ট করেননি। অর্থাৎ বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পেলেও তা থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই বললেই চলে। বাজেটের আকার যাই হোক না কেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কর আদায়ে ‘এনবিআর’-এর ওপর আরও বেশি চাপ থাকবে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এনবিআরকে সংগ্রহ করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে ব্যাংক সেক্টরের যে দুরবস্থা চলছে তাতে সাধারণ জনগণ খুব বেশি টাকা ব্যাংকে রাখার সাহস পাচ্ছে না....

পূর্ববর্তী বছরগুলোয় কর আদায়ের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে বলা যায় কর আদায়ের এই নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতিপূর্ণ দিক হলো বৈধভাবে অর্জিত আয়ের ওপর সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে, যেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে যত খুশি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং এতে করে ভবিষ্যতে দুর্নীতি আরও বেশি প্রশ্রয় পাবে বলে ধারণা করছি।

অন্যদিকে যারা সৎভাবে আয় করে কর দিচ্ছেন তাদের মধ্যে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি থাকবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে। ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করার পরও নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণের বোঝা যথারীতি থাকছেই। অভ্যন্তরীণ ঋণের ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সংগ্রহ করা হবে। বর্তমানে ব্যাংক সেক্টরের যে দুরবস্থা চলছে তাতে সাধারণ জনগণ খুব বেশি টাকা ব্যাংকে রাখার সাহস পাচ্ছে না। এই অবস্থায় সরকার যদি ব্যাংক সেক্টর থেকে বিশাল পরিমাণে ঋণ সংগ্রহ করে তবে নিঃসন্দেহে ব্যক্তিখাতে ঋণের সরবরাহ কমে আসবে এবং এই খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু ভালো দিক হলো বরাবরের মতো এবারও কৃষি উপকরণ এবং সারের ওপর কোনো বাড়তি শুল্ক বসানো হয়নি। নির্মাণ সামগ্রীতে নতুন করে কোনো শুল্ক আরোপ করা হয়নি। মোবাইল ফোনের কল চার্জের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানোর ফলে অপ্রয়োজনীয় ফোনালাপ কমে আসবে।

তাছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটের এডিপিতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম খাতে বরাদ্দ বাড়ছে, যা দেশের সাধারণ জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিলেও তা চলতি অর্থ বছরের তুলনায় বেশ কম। এতে করে এই খাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

নতুন অর্থমন্ত্রী বিগত অর্থমন্ত্রীর ছক অনুসরণ করে অনেকটা গতানুগতিক বাজেট পেশ করেছেন। তবে অনেক খাতে তিনি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছেন এবং মূল্যস্ফীতি কমানোকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যা বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তিযুক্ত।

মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল কী হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় বাজেটের সফলতার বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সরকার যদি তার প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে এই দুটো লক্ষ্য অর্জনে কিছুটা সফল হয় তবেই এই বাজেটকে জনবান্ধব বা গণমুখী বলা যাবে।

ঝুলন ধর ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়