ছবি : সংগৃহীত

গাছপালা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আমাদের জন্য শুধু খাদ্যই সরবরাহ করে না, বরং আমাদের এবং অন্যান্য প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে। গাছপালা ক্ষয় রোধ করে মাটি একসাথে রাখতে সাহায্য করে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গাছপালা পানি চক্রের একটি অপরিহার্য অংশ। তারা মাটি থেকে শিকড়ের মাধ্যমে পানি শোষণ করে পাতার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় জলীয় বাষ্প তৈরি করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। ধারণা করা হয় যে, আকাশে মেঘ সৃষ্টির শতকরা ১০ ভাগ জলীয় বাষ্প আসে গাছের ইভাপোট্রান্সপিরেশন (Evapotranspiration) বা বাষ্পী প্রস্বেদনের মাধ্যমে।

শুধু তাই নয়, গাছপালা নদী, হ্রদ এবং স্রোতের মতো জলাধারকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। উদ্ভিদের শিকড় মাটির স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ভূমিধস প্রতিরোধ করে এবং এই বাস্তুতন্ত্রকে অক্ষত রাখে। আজ বিশ্বের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো। যার ফলে বায়ুমণ্ডলে উচ্চ স্তরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড রয়েছে। গাছগুলো বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিধায় গাছ কার্বন সিংক বা কার্বন সংরক্ষণাগার হিসেবে কাজ করে উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

গাছের সবুজ পাতার আচ্ছাদন সূর্যরশ্মিকে আটকিয়ে আমাদের পরিবেশকে শীতল রাখতে সাহায্য করে। কিছুদিন পূর্বে স্মরণকালের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র তাপদাহের সময় আপামর জনতা গাছের গুরুত্ব অনুভব করেছে। ভর দুপুরে তীব্র গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে খেটে খাওয়া মানুষগুলো গাছের ছায়াতলে বসে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

তীব্র তাপপ্রবাহের পর আঘাত হেনেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। সেইখানেও এদেশের অন্যতম সম্পদ সুন্দরবনের সবুজ গাছাপালা বুক চিতিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে আমাদের। রেমালের তাণ্ডবে ও জলোচ্ছ্বাসে বনের বন্যপ্রাণী, গাছপালাসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও রক্ষা পেয়েছি আমরা। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে ভরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।

পরিবেশের সাথে জীববৈচিত্র্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন জীববৈচিত্র্যের সমস্যা হয় তখন মানব সভ্যতা হুমকির সম্মুখীন হয়। জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অংশীজন উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অণুজীবের মধ্যে রয়েছে একটি নিবিড় মিথষ্ক্রিয়া। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি আমাদের স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রা হুমকির মুখে ফেলেছে, বেড়েছে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত রোগ প্রসারিত হওয়ার আশঙ্কা।

নগরায়ন পরিবেশের নিউক্লিয়াস তথা বাস্তুতন্ত্রকে ঋণাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এই সত্য বিবেচনায় বন্য প্রাণীদের জন্য একটি নিরাপদ প্রাকৃতিক আশ্রয় দিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির গাছপালাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। শহরের চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে বন্যপ্রাণীর জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। 

গাছগুলো বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিধায় গাছ কার্বন সিংক বা কার্বন সংরক্ষণাগার হিসেবে কাজ করে উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বজ্রপাত। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক বজ্র নিরোধক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই তালগাছ। রবীন্দ্রনাথ ‘তালগাছ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে…’।

আমাদের বাঁচাতেই তালগাছ আকাশে উঁকি মেরে তার মাথার মুকুট দিয়ে বজ্রপাতকে নিজের মাথায় টেনে নেয় এবং নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে আমাদের রক্ষা করে। গাছপালা আমাদের জীবন ধারণের জন্য শুধুমাত্র খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় দিয়ে ক্ষান্ত হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেও আমাদেরকে রক্ষা করে।

পরিবেশের কথা আসলেই গাছ লাগানোর কথা আসে। এবারের তীব্র তাপপ্রবাহের সময় অনেকেই গাছ লাগিয়েছেন। গাছ লাগানোর তাগিদ সবাই অনুভব করেছেন। এটি একটি শুভ লক্ষণ। গাছ লাগানো কার্যক্রমকে অবশ্যই টেকসই এবং ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হলো বর্ষাকাল। সেই বিবেচনায় প্রাক-বর্ষায় গাছ লাগানো শুরু হবে। পুরো বর্ষাকাল এবং প্রাক-শরৎকাল ধরেই গাছ লাগানো যাবে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পানিতে চারাগাছগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। 

গাছপালা ভূমি বিন্যাসের অন্যতম অংশীজন। সবুজ গাছপালা আরামদায়ক পরিবেশ, বাড়ির পর্দা এবং মাটির সুরক্ষাসহ নানাভাবে আমাদের সাহায্য করে। গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে গাছের আকার, আকৃতি, পাতার ঘনত্ব, গঠন, মূলের পরিধি এবং কাণ্ডের বৃদ্ধির মতো বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে বিবেচ্য। যেমন দেবদারু (Polyalthia longifolia) কম বিস্তৃত হয়ে সোজাভাবে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বট (Ficus benghalensis), অশ্বত্থ (Ficus religiosa) এবং রেইন ট্রি (Samanea saman) জাতীয় গাছগুলোর পাতার ক্যানপি ছাতার মতো বিস্তৃত।

অশোক (Saraca asoca), বকুল (Mimusops elengi) ঘন পাতাওয়ালা এবং ক্যানপি ছাতার মতো বিস্তৃত হলেও এরা মাঝারি ধরনের বৃক্ষ। এসব বিবেচনায় গাছ লাগানোর স্থান, ভৌত পরিবেশ এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়। গাছ লাগানোর পূর্বেই জেনে নিতে হবে যে, গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে জননিরাপত্তা বা ভৌত কাঠামোর কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না। শহরে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে বৃক্ষ জাতীয় গাছ হলে তা ভৌত কাঠামো থেকে কমপক্ষে ১০-১৫ ফুট দূরে লাগাতে হবে যেন শিকড় এবং বায়বীয় শাখাগুলো বিস্তৃত হওয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা পায়।

বৃক্ষ জাতীয় গাছের শিকড় এবং কাণ্ড অনেকটা সমানভাবে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। একারণেই রোপিত চারাগাছটি অনেক সময় বৃদ্ধি পেয়ে ভৌত কাঠামোর ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই বিবেচনায় ভবনের আশেপাশে গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ নির্বাচন করাই শ্রেয়। বাড়ির আঙিনায় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্মুক্ত স্থানে ফলদ গাছ হিসেবে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জাম্বুরা, জামরুল, সফেদা, ডালিম, ডেওয়া, লেবু, জলপাই, আমলকী জাতীয় গাছ থেকে নিজের পছন্দ মতো গাছ লাগাতে পারেন।

এদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার পূর্বেই পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ বেল (Aegle marmelos) লাগানোর কথা ভাবতে পারেন। ঢাকা অঞ্চলের মাটি বিশেষ করে সাভার, গাজীপুর এবং নরসিংদী অঞ্চলে কাঁঠাল (Artocarpus heterophyllus), লিচু, লটকন (Baccaurea motleyana), কলা, লেবু জাতীয় ফল ভালো হয়।

ইদানীং আম্রপালি আমেরও চাষ হচ্ছে। ফুল বা শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবে শিউলি, কুরচি, বকুল, ছাতিম, সোনালু, উদাল, স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা, কাঠগোলাপ, কামিনী, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, অশোক, পলাশ, মহুয়া, সুরভীরঙ্গন বিবেচনা করা যেতে পারে।

লতানো বা ছোট গাছ হিসেবে গোলাপ, হাইড্রাঞ্জিয়া (Hydrangea macrophylla), রঙ্গন, জবা, তারাঝরা, নীলমণিলতা, মাধবীলতা, নীলঘণ্টা, টগর, গন্ধরাজ ও বেলি ফুল লাগানো যেতে পারে।

গাছ লাগানোর স্থান, ভৌত পরিবেশ এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়। গাছ লাগানোর পূর্বেই জেনে নিতে হবে যে, গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে জননিরাপত্তা বা ভৌত কাঠামোর কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না।

ঔষধি গাছ হিসেবে প্রথমেই বিবেচ্য হবে নিম গাছ। একটি প্রবাদ আছে, যে বাড়ির দক্ষিণ দিকে যদি নিম গাছ থাকে সেই বাড়িতে কোনো রোগবালাই থাকে না। নিম ছাড়া বাসক, নিশিন্দা, অর্জুন, সাজনা, আমলকী, হরিতকী, বহেরা ইত্যাদি ভেষজ গাছ লাগানো যেতে পারে। বসতবাড়ির আঙিনায় তুলসী, বাসক, পাথরকুচি, ঘৃতকুমারী, জবা, গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা, তারাঝরা লাগিয়ে বাড়ির শোভাবর্ধন করতে পারেন এবং ভেষজ গুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ থেকে জ্বর, সর্দি-কাশি ও পেটের পীড়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা পেতে পারেন। বাড়ির দেয়ালের সাথে মধুমঞ্জরী, নীল অপরাজিতা, নীলঘণ্টা, অলকানন্দা, রোজ ক্যাকটাস লাগিয়ে বায়োপর্দা তৈরি করে বাড়িকে শীতল এবং নান্দনিক করতে পারেন।

শহরের রাস্তার দ্বীপ বা রোড মিডিয়ানে গুল্ম জাতীয় গাছ লাগানোই শ্রেয়। সেই বিবেচনায় রক্তকরবী, কাঞ্চন, কামিনী, ক্রাইনাম লিলি, পাতাবাহার, লাইলি মজনু, বাগান বিলাস, অলকানন্দা, বিচিত্রা (আজ-কাল-পরশু), সুগন্ধি জয়তী, ছোট জারুল এবং ছোট রাধাচূড়া জাতীয় গাছ নির্বাচন করা যেতে পারে।

রাস্তার পাশে অ্যাভিনিউ ট্রি হিসেবে ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ এবং মানসিক শান্তি প্রদানে সোনালু (Cassia fistula), নিম (Azadirachta indica), অশোক (Saraca asoca), বকুল (Mimusops elengi), জারুল (Lagerstroemia indica), অশ্বত্থ (Ficus religiosa), ছাতিম (Alstonia scholaris), নাগেশ্বর (Mesua ferrea), পলাশ (Butea monosperma), শিমুল (Bombax ceiba) এবং উদাল (Sterculia villosa) ইত্যাদি গাছ রোপণের পরামর্শ রইল। এসব গাছের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দেশীয় প্রাণীদের।

পরিবেশের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উল্লেখিত গাছগুলো ধনাত্মক ভূমিকা রাখতে পারবে। গ্রামীণ জনপদে বা হাট-বাজারে বট, অশ্বত্থ, বড় জারুল, কনকচূড়া (Peltophorum pterocarpum), রেইন ট্রি (Samanea sama), মেন্দা (Litsea glutinosa), বহেরা (Terminalia bellirica) জাতীয় গাছ লাগানো যেতে পারে।

জলাধারের পাশে হিজল (Barringtonia acutangula), করচ (Pongammia pinnata), বরুণ (Crateva religiosa) ও দেশীয় গাব (Diospyros discolor) গাছ লাগানো যেতে পারে। হেঁটে চলার পথের পাশে হিজল, ছাতিম, মহুয়া, কাঠ গোলাপ, স্বর্ণচাপা, উদাল, কুরচি, রক্তন, সোনালু, পলাশ, শ্বেত শিমুল, বকুল, শিউলি, চালতা, হলুদ করবী, টেকোমা ও শেওড়া জাতীয় গাছ ভালো।

এই গাছগুলো যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে তেমনই পরিবেশ শীতল রাখতে সাহায্য করবে। পাখি অন্যান্য প্রাণীদের আবাসস্থল এবং খাদ্যের জন্য পার্ক বা উদ্যানে কনকচূড়া, বট, ডুমুর, তমাল, তেঁতুল, গাব, মহুয়া, ডেউয়া, কামরাঙা, বিলম্বি এবং বিভিন্ন ধরনের পাম জাতীয় গাছ লাগানের গুরুত্ব রয়েছে।

সর্বোপরি সঠিক গাছ সঠিক স্থানে রোপণের কোনো বিকল্প নেই। উদ্ভিদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, স্থানের উপযোগিতা এবং ব্যবহারকারীর কার্যকরী ও নান্দনিক চাহিদার বিবেচনায় সঠিক গাছ নির্বাচন এবং রোপণ একটি স্বাস্থ্যকর, দীর্ঘজীবী, পরিবেশবান্ধব কম রক্ষণাবেক্ষণ এবং কম ব্যয়বহুল ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে কার্যকর এবং ব্যবহারকারীর জন্য উপভোগ্য হবে।

ড. মিহির লাল সাহা ।। অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sahaml@du.ac.bd