ছবি : সংগৃহীত

প্রশাসনে যারা থাকেন, ক্ষমতায় থেকে তাদের কেন দুর্নীতি করতে হবে? তারা কি দুর্নীতি করার জন্য ওই পদে গিয়েছেন? ক্ষমতায় বসানো হয় জনগণের সেবা করার জন্য। সেই জায়গায় ভয়াবহ দুর্নীতিপরায়ণ হতে হবে কেন? কেন তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে রাষ্ট্রের এত দ্বন্দ্ব।

একজন মানুষের জীবন চালাতে আসলে কত টাকার প্রয়োজন? প্রশ্নটা যারা আমজনতা, হয়তো তাদের মাথায় ঘোরে। কিন্তু যারা অঢেল সম্পদের মালিক তাদের হয়তো এই প্রশ্নটাও মাথায় আসে না। একটা বাড়ি, একটা গাড়ি, একটু জমি বা ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা।

ধরা যাক, কেবল দেশেই না, বিদেশেও একইভাবে বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমানো দরকার। তাও হলো। ব্যাংকে শত কোটি টাকা হলো। তারপর তো মানুষ থামে। কিন্তু কেউ কেউ আছে আর থামে না। থামতেই যেন ভুলে গেছেন। 

পুলিশের কর্তা ব্যক্তিদের টাকার অভাব নেই, এটা সবারই ধারণা। নানা সময় বলার চেষ্টা হয়েছে যে, এই দেশের পুলিশ আসলে অসৎ নয়। কিন্তু এই বক্তব্য সুবিধা করতে পারছে না, জনমনের ধারণা বদলাতে পারছে না।

জনগণ হয়তো ধারণা করে তারা অসৎ উপায়ে অর্থ বানায় কিন্তু সেই ধারণার কোথাও নেই—যারা অসৎ তারা আসলে কত টাকার মালিক? কী পরিমাণ সম্পদের মালিক? সাবেক আইজিপির আলাদিনের চেরাগের খবর মানুষকে সেই ধারণা দিয়েছে।

যখন একদিনে অভিজাত এলাকায় ৪টা ফ্ল্যাট কিনে ফেলা যায়। তখন কত টাকা থাকলে তা সম্ভব তার সামান্য ধারণা করা যায়। কিন্তু এই টাকা এলো কোথা থেকে? তা বৈধ নাকি অবৈধ?

একজন পুলিশ মহাপরিদর্শকের বেতন স্কেল ৭৭ হাজার টাকা। যদি তিনি সিনিয়র সচিব মর্যাদার হোন তবে বেতন হবে ৮২ হাজার টাকা। তার সাথে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা, গাড়ি খরচসহ নানান কিছু যুক্ত হয়। তবে সেই টাকা জীবন ধারণেই ব্যয় হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই পরে যা খবর পাওয়া গেছে তাতে আসলেই চেরাগ ছাড়া এত সম্পদ বানানো সম্ভব নয়।

একজন মানুষের জীবন চালাতে আসলে কত টাকার প্রয়োজন? প্রশ্নটা যারা আমজনতা, হয়তো তাদের মাথায় ঘোরে। কিন্তু যারা অঢেল সম্পদের মালিক তাদের হয়তো এই প্রশ্নটা মাথায়ও আসে না।

সাবেক আইজিপির মোট জমি ১০৯ একর। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে।

জানা গেছে, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে এক মাসে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। মতান্তরে ১০০ কোটি টাকার মতো। এর বাইরে নানা জায়গায় রিসোর্ট আর বাগান বাড়ি তো আছেই। পাওয়া গেছে বিদেশেও সম্পদের খোঁজ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের পাম জুমেইরাহ ও মেরিনা এলাকায় বেনজীরের নামে-বেনামে বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে পাম জুমেইরাহ এলাকার ৪০ তলা কনকর্ড টাওয়ারে অবস্থিত একটি অ্যাপার্টমেন্ট অতিসম্প্রতি ৯০ লাখ দিরহামে (২৮ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বিক্রি করেছেন।

নানা সময় বলার চেষ্টা হয়েছে যে, এই দেশের পুলিশ আসলে অসৎ নয়। কিন্তু এই বক্তব্য সুবিধা করতে পারছে না, জনমনের ধারণা বদলাতে পারছে না।

এছাড়া বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দুবাইয়ের ‘মস্কো’ নামের একটি বহুতল হোটেলে বেনজীরের যৌথ বিনিয়োগের তথ্যও আছে। আর ঢাকার ভাটারা থানার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বেনজীরের একটি সাততলা ভবন ছিল। তাও সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর এসব সম্পদ বিক্রি করা হয়েছে বলে দুদক জানতে পেরেছে।

জানা গেছে সাবেক আইজিপি দেশে নেই। মে মাসের ২৭ বা ২৯ তারিখে তিনি সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। অথচ তার এই দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে ২ মাস আগে মার্চ মাসে। এর মধ্যে হয়েছে মামলাও। কিন্তু আমাদের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা জানেন না।

দুদকও নাকি দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। কারণ খুবই সরল। তারা মনে করেছে, মামলা হলেও এই দেশে তিনি থাকবেন এবং বিচার হলে তিনি জেলে যাবেন। সাবেক আইজিপির প্রতি দুদকের আস্থা বিশাল! তবে সেই আস্থা শেষ করে দিয়ে পুলিশ কমিশনার দেশ ছেড়েছেন, সাথে নিয়ে গেছেন শত কোটি টাকা।

যেসব ব্যাংকে একাউন্ট আর ফিক্সড ডিপোজিট ছিল তারা খুব ভালো করেই জানেন এসব অর্থ অবৈধ। কারণ ততদিনে বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির খবর ছড়িয়েছে। তবু এই অর্থ তারা তাকে ফেরত দিয়েছেন, কাউকে কিছু জানতেও দেননি।

সেই টাকার পরিমাণ প্রায় ৭০-৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো তা করেছে কোনো প্রশ্ন ছাড়া। ব্যাংকগুলো কি এই দায় এড়াতে পারবে? সাবেক আইজিপি টাকা তুলে নিচ্ছেন এই তথ্য তারা কাউকে জানাননি এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?

এত টাকা আসলে বেনজীর আহমেদ কেমন করে পেয়েছেন? এই পদে থেকে এত এত টাকা আয় করা কি সম্ভব? ধারণা করা যায়, অবৈধ সুযোগ সুবিধা বা অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া, অপরাধকে সহায়তা করা, যা কিছু দেশের জন্য অমঙ্গল তা করতে দেওয়ার বিনিময়ে নানাভাবে এইসব অবৈধ অর্থ আদায় করা হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্থ তিনি কি একাই আদায় আর ভোগ করেছেন? আর কেউ তা জানতেন না? বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থাকা মানুষটার কার্যক্রম তার গতিবিধি নজরে রাখা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই করা হয়। কাজেই কেউই জানতেন না তিনি এত অবৈধ সম্পদের মালিক, এটি বিশ্বাস করা কষ্টকর।

যদি ধরেও নিই যে তিনি একাই সব করেছেন বা কেউ কিছুই জানেন না তাহলে বেনজীরকে দেশ ছাড়ার বিষয়ে সহায়তা করেছেন কে? কারা তাকে ব্যাংক থেকে সব অর্থ তুলে নিয়ে যাওয়ার সহায়তা করলেন? তাদের কি চিহ্নিত করা হবে?

অপরাধ করা আর অপরাধীকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা একই কথা। যারা সহায়তা করেছেন তারাও আছেন ঠিকঠাক জায়গায়, আরেকজন বেনজীরের আশায়।

নাজনীন মুন্নী ।। সাংবাদিক