ছবি : সংগৃহীত

বহুকাল ধরেই বাংলার গ্রামীণ জনপদের অপার সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছে। বাংলার রূপমাধুরী উপজীব্য করেই কত কবি-সাহিত্যিক বিখ্যাত হয়েছেন। কতজনে কতভাবেই না গ্রামবাংলার রূপের বর্ণনা করেছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় তো বলেই দিয়েছেন, 'বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’।

আবহমান বাংলার সৌন্দর্য নিয়ে কোনোকালেই প্রশ্ন তোলেননি কেউ। অথচ বাংলাদেশে পর্যটন খাতের দুর্দশা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই শুনতে হয়, বিদেশি পর্যটকদের টানার মতো এমন কী আর আছে আমাদের দেশে?

সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও সাজেক ভ্যালিসহ হাতেগোনা কয়েকটি জায়গার নাম। নানান ধরনের অব্যবস্থাপনার কারণে এই স্পটগুলো নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহও তলানিতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত হিসেবে তুলে ধরা হয় কক্সবাজার, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন কিংবা পাহাড়ি সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি কিংবা বান্দরবানকে।

গোটা দুনিয়াজুড়েই এমন পাহাড়, সমুদ্র সৈকত কিংবা প্রবাল দ্বীপ রয়েছে। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও যা নেই, তা হলো 'গ্রামবাংলা'। চিরায়ত বাংলার গ্রাম আমাদের কবিতায় আছে, গল্পে আছে, সিনেমায় আছে কিন্তু এটি পর্যটন পরিকল্পনায় নেই।

গ্রামবাংলার সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেও যে বিপুল সংখ্যক বিদেশি পর্যটক টেনে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা সম্ভব, তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই।

মানুষ কীসে আকৃষ্ট হয়? যা নতুন, যা আর কোথাও নেই, আগে কখনো দেখেনি, তাই তো চুম্বকের মতো টানে মানুষকে। পাহাড়, সমুদ্র তো বহু দেশেই আছে। ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন হলেও দৃশ্যগত তারতম্য খুব বেশি নয়।

কেউ আবার ভেবে বসবেন, আমি বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কিংবা পাহাড়ি জনপদকে ছোট করে কথা বলছি। আমি নিজেই পাহাড় আর সমুদ্র খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমি যেখানেই যাই আমার অন্তরে থাকে গ্রাম। শুধু আমার বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরেই গ্রাম থাকে, আছে, থাকবে। কিন্তু নেই শুধু গ্রাম নিয়ে পরিকল্পনা। যাদের পরিকল্পনা করার কথা, তারা থাকেন সুউচ্চ অট্টালিকায়, যেখান থেকে গ্রাম দেখা যায় না।

সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে গ্রামবাংলা। কিন্তু তার আগে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামবাংলার সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত, বসন্ত কিংবা হেমন্ত; একেক ঋতুতে একেক রূপ নিয়ে হাজির হয় গ্রামবাংলা। এমন ঋতুবৈচিত্র্য আর কোথাও আছে বলে শুনিনি।

আমি যেখানেই যাই আমার অন্তরে থাকে গ্রাম। শুধু আমার বললে ভুল হবে, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরেই গ্রাম থাকে, আছে, থাকবে। কিন্তু নেই শুধু গ্রাম নিয়ে পরিকল্পনা। যাদের পরিকল্পনা করার কথা, তারা থাকেন সুউচ্চ অট্টালিকায়, যেখান থেকে গ্রাম দেখা যায় না।

বাংলাদেশে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে নদ-নদী। প্রতিটি নদীই নিজস্ব রূপে অনন্য। নদীর তীরে গড়ে ওঠা গ্রাম, খেয়া নৌকায় পারাপার কিংবা নদীকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবনের জলছবি দেখে আজও আমরা আপ্লুত হই। কিন্তু ভুলেও আমরা ভাবি না, এই সৌন্দর্য দিয়ে দর্শনার্থী আনা যায়, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে।

শুধু কি নদী? খাল-বিল, পুকুর-ডোবারও আলাদা সৌন্দর্য আছে। শুষ্ক কিংবা বর্ষার ভরা মৌসুমে এগুলোর রূপের পরিবর্তন হয়।

গ্রামবাংলার ফসলের মাঠের নান্দনিকতা অতুলনীয়। দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেতে যখন বাতাস দোল দিয়ে যায়, তখন ধানের শীষের মতো মনটাও যেন দোলে ওঠে।

কবি তো এমনি এমনি ফসলের মাঠকে 'নকশি কাঁথার মাঠ' বলেননি। ভোরবেলায় সবুজ ঘাসের ডগায় মুক্তার দানার জ্বলজ্বল করা শিশিরবিন্দু যে মুগ্ধতা ছড়ায় মনে তা অতুলনীয়। কোনো এক শীতের সকালে বিদেশি কোনো এক পর্যটককে খালি পায়ে জমির আইলের শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটিয়ে দেখুন না একবার। কুয়াশা মাখা গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ একেবারেই অনন্য।

শুধু প্রকৃতি নয়, ব্যতিক্রমী জীবনের চিত্র দেখার জন্যও আধুনিক বিশ্বের পর্যটকরা মরিয়া। গ্রামের ঘরবাড়ি, উঠান, মুরগির ঘর কিংবা গরুর গোয়ালও আকর্ষণ করতে পারে। গ্রামীণ পোশাক-আশাক, খাবারের থালাবাটি, কৃষিজ যন্ত্রপাতি সবকিছুই আকর্ষণের অনুষঙ্গ হতে পারে।

গ্রামের ঈদ-পূজা-পার্বণ, মেলা কিংবা মাছ ধরার উৎসবও গ্রামীণ পর্যটনের বিরাট উপাদান। সেইসাথে গ্রামীণ হাটবাজারগুলোও পর্যটকদের মনে দাগ কাটতে পারে।

শীতের সময় গ্রামবাংলার কত ধরনের সুস্বাদু পিঠাপুলি তৈরি হয়। এছাড়া একেক জায়গার একেকটি খাবার বিখ্যাত। বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম কিংবা কুমিল্লার রসমালাইয়ের খ্যাতির কথা আমরা কে না জানি। কিন্তু এই খাবারগুলোও যে বিদেশিদের আকর্ষণ করতে পারে, সেই কথা কি কখনো আমরা ভেবেছি কেউ?

জারি, সারি, কবিগান, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, মুর্শিদি-মারফতিসহ সারা বাংলায় ছড়িয়ে আছে কত গান। দিনের শেষে কুপি বাতির আলোয় বসা আসরে যদি কেউ গেয়ে গেয়ে ওঠে, 'মাঝি বাইয়া যাওরে' কেমন হবে বলুন তো?

গ্রামবাংলা বিচিত্র স্বাদের সব ফলফলাদি উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। একেক সময়ে একেক ফল পাওয়া যায় গ্রামে। দুনিয়ার সবচেয়ে সুস্বাদু ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয় আমকে। রাজশাহীর আম গোটা পৃথিবীতে সুপরিচিত। ইতিমধ্যে এই আমকে ঘিরে পর্যটনের সূত্রপাত হয়ে গেছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আগে শুধু আম কেনার উদ্দেশ্যেই মানুষজন যেতেন।

কয়েক বছরে বদলে গেছে চিত্র। যে পরিবার প্রতি গ্রীষ্মে দেশ-বিদেশের গতানুগতিক কোনো টুরিস্ট স্পটে যেতেন, তারাই এখন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে যাচ্ছেন আম বাগানের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। এই কারণে ইতিমধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে আম বাগানের ভেতর কিছু কটেজ তৈরি হয়েছে, দিন দিন যা বাড়ছেই।

জারি, সারি, কবিগান, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, মুর্শিদি-মারফতিসহ সারা বাংলায় ছড়িয়ে আছে কত গান। দিনের শেষে কুপি বাতির আলোয় বসা আসরে যদি কেউ গেয়ে গেয়ে ওঠে, 'মাঝি বাইয়া যাওরে' কেমন হবে বলুন তো?

একইভাবেই মধুপুরের আনারস, নরসিংদীর লটকন, দিনাজপুরের লিচু, গাজীপুরের কাঁঠাল, বরিশালের পেয়ারাই হতে পারে পর্যটনের বিরাট অনুষঙ্গ। বলে রাখি, বরিশালের ভিমরুলি পেয়ারার বাজার ও বাগানকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর ধরেই বিপুল সংখ্যক পর্যটক ভিড় জমাচ্ছেন। ধীরে ধীরে বিদেশিদের নজরেও আসছে ভাসমান পেয়ারার বাজারটি।

গ্রামবাংলাকে ঘিরে পর্যটনের দুয়ার উন্মুক্ত হলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে ত্বরান্বিত হবে। পর্যটকদের থাকার জন্য গ্রামের মানুষেরা নিজেদের বাড়িতে হোমস্টে (Homestay) চালু করতে পারবেন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই অতিথির জন্য একটি করে কক্ষে থাকে, সেই কক্ষেই তারা শুরু করতে পারে কার্যক্রম।

আমরা বিদেশে গিয়ে যেভাবে থাকার পাশাপাশি ওই পরিবারের সাথেই খাবার খাই। এখানেও তো সেইটাই হতে পারে। এর মাধ্যমে রাত্রিযাপনের পাশাপাশি ট্র্যাডিশনাল খাবারেরও স্বাদ নিতে পারবেন পর্যটকরা। এভাবেই কিন্তু গ্রামের মানুষের হাতে কিছু অর্থ চলে আসতে পারে।

যখন পর্যটনের সম্ভাবনা তৈরি হবে, তখন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে প্রত্যেকেই তাদের বাসস্থানকে পরিপাটি করার চেষ্টা করবেন। যা গ্রামের অবয়বকে আরও সুন্দর করবে। এছাড়া বিত্তবানদের উদ্যোগে নদীর ধারে কিংবা ফসলের মাঠের পাশে তৈরি হতে পারে পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিনন্দন কটেজ।

শুধু কী তাই, পর্যটনের বিকাশ ঘটলে সেই এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বাণিজ্যেরও অভাবনীয় প্রসার ঘটে। স্থানীয় অনেক পণ্য যা দেশের মানুষের কাছে তুচ্ছ, তাই হয়তো বিদেশিদের আছে আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে যাবে, তারা তা উচ্চমূল্যে কিনতে থাকবেন।

বাংলাদেশের গ্রামকে পর্যটনের জন্য ব্র্যান্ডিং করতে হলে সারা বিশ্বের সামনে তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এজন্য দেশি-বিদেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কাজে লাগাতে পারে কর্তৃপক্ষ। হয়তো বলবেন, দেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটররার তো কাজ করছেনই, নতুন করে করার কী আছে? বিষয়টি হলো বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করা এক জিনিস, আর কোনো লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে কাজ করাটা অন্য রকম।

তবে আমি মনে করি বিদেশি জনপ্রিয় ট্রাভেল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রামবাংলাকে তুলে ধরা গেলে বহির্বিশ্বে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বিষয়টি। এছাড়া দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়েও বাড়ানো যায় প্রচারণার পরিধি।

সেই সাথে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণে মনোনিবেশ করতে হবে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গরু দিয়ে আর হালচাষ হয় না বললেই চলে। কিন্তু চাষের লাঙলটি তো সংরক্ষণ করা যায়। কে জানে, কোনো বিদেশি পর্যটকের কাছে সেইটিই হয়তো হবে যাবে আগ্রহের বিষয়বস্তু।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই, গ্রামবাংলায় লুকিয়ে আছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। তা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করলে সারা দুনিয়ার ভ্রমণপিপাসুদের গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ।

সালাহউদ্দীন সুমন ।। কনটেন্ট ক্রিয়েটর