হুমায়ূন ফরীদি : যার আন্তরিকতায় হৃদয় জুড়িয়ে যেত
প্রথমবার বোধহয় কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা এবং আবদুল্লাহ রানার পরিচালনায় টেলিফিল্ম ‘গেস্ট হাউজ’-এ। হুমায়ূন ফরীদি স্যার, আলী যাকের চাচা, আসাদুজ্জামান নূর চাচা, পারভীন সুলতানা দিতি আন্টি, সুবর্ণা মুস্তাফা আপা, ফজলুর রহমান বাবু ভাইদের মাঝে আমি ২২ বছরের চট্টগ্রাম-ঢাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম করা এক এ্যামেচার।
হা করে গিলতাম সবার কথা। একটা কম্বাইন্ড সিন ছিল যেখানে হুমায়ূন ফরীদির অভিনয় দেখে হাসি চাপা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। হেসেও ফেলেছিলাম বোধহয় দুই-একবার। কী একটা অবস্থা!
বিজ্ঞাপন
তারপর বিরতি। বিরতি থেকে ফিরে, বিয়ে হয়েছে তখনো সন্তান হয়নি, একটু একটু কাজ করছি। নাটকের নাম ‘পারাপার’। অনিমেষ আইচের রচনায় পরিচালনা করেছেন অরণ্য আনোয়ার।
আরও পড়ুন
আমার শুধু মনে আছে ফরীদি স্যারের কথা। শুটিং হাউজে তিনি ঘড়ি ধরে আসতেন, কাজ করতেন তারপর সময়মতো চলে যেতেন। সেই নাটকে তার সাথে আমার কোনো দৃশ্য বোধহয় ছিল না। কিন্তু মেকাপ রুম বা রূপসজ্জা কক্ষে অনেক দৃশ্য ঘটতে থাকল।
তার প্রশ্নের ভয়ে তটস্থ থাকত শুটিং টিম। ধরুন, ক্যামেরাম্যানকে উনি ডাকলেন। ডিওপি বলার চল তখনো শুরু হয়নি। কী ক্যামেরা জেনে তিনি তৎক্ষণাৎ কিছু প্রশ্ন করতেন। বেচারার ধরণী দ্বিখণ্ডিত হলেই বোধহয় ভালো ছিল। বকা দিতেন না। শুধু জিজ্ঞেস করতেন, তারপর নিজেই উত্তর দিয়ে দিতেন। এমন অবস্থায় আমি আগেই আত্মসমর্পণ করতাম আর অভিনয় সংক্রান্ত নানারকম প্রশ্ন করতাম।
দুপুরে তার জন্য কফি ওয়ার্ল্ড থেকে একজন সহযোগী স্যান্ডউইচ নিয়ে আসতেন। তিনি একটা খেয়ে আরেকটা রেখে দিতেন আমার জন্য। আমি অবাক হয়ে যেতাম এই ভেবে যে, আমি তার কাছে কিছুই না। এই ‘কিছুই না’-এর প্রতি আন্তরিকতা দেখে তখনো বুঝিনি যে আমার অবাক হওয়ার যাত্রা মোটে শুরু।
নানাবিধ প্রশ্নের মাঝে একদিন তিনি কিছু বই নিয়ে আসলেন আমার জন্য। কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভস্কি (Konstantin Stanislavski)-এর দুটো বই। সাথে স্তানিস্লাভস্কির ছাত্রী সোনিয়া মুর-এর একটা বই। দিলেন। আমি ‘হা’ হয়ে গেলাম। আমার ‘হা’ আর বন্ধ হয় না। ফরীদি স্যার স্তানিস্লাভস্কির বই দিচ্ছেন আমাকে? কেন?
আমার শুধু মনে আছে ফরীদি স্যারের কথা। শুটিং হাউজে তিনি ঘড়ি ধরে আসতেন, কাজ করতেন তারপর সময়মতো চলে যেতেন। সেই নাটকে তার সাথে আমার কোনো দৃশ্য বোধহয় ছিল না...
এই ‘কেন’ প্রশ্নটা গলায় আটকে গেল। আসলে আমি ভাবছিলাম, আমি কি ‘ডিজার্ভ’ করি? সুরিয়াল (SuReal) একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। কী বলব, কী করব সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। পাঠকরা ভাবতে পারেন, বই নিয়ে এত ন্যাকামির কী আছে!
অভিনয়ের প্রশিক্ষণ হাতেকলমে নেওয়া এবং থিয়েটার করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা এই কাঁপাকাঁপির রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন। তাকে জানাই আমি ফটোকপি করে বই ফেরত দিয়ে আসব। তিনি হেসে বললেন, লাগবে না। আমার মুখ তখনো হা হয়েই আছে।
তিনি আশ্বস্ত করলেন, বললেন এই বইগুলোর কাজ শেষ। আমার কোনোদিন শেষ হলে যার প্রয়োজন তাকে যেন আমি দিয়ে দিই। আহ্ তিনি যদি জানতেন, এই প্রয়োজন আমার কখনোই মিটবে না।
আরও পড়ুন
ফরীদি স্যারের সাথে ফেসবুকে যুক্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে তার সাথে ছোট ছোট আলাপ হতো। একসময় বিশাল বইয়ের সংগ্রহ ছিল। তারপর অল্পকিছু আক্ষেপ, ওগুলো তার ব্যক্তিগত হওয়ার কারণে যুক্ত করলাম না।
তিনি একাই থাকতেন। আমার বরকে নিয়ে তার সেই সময়ের বইয়ের সংগ্রহ দেখার জন্য একদিন সন্ধ্যায় যেতে বললেন। আমি খুশিতে আটখানা। যাওয়া আর হয়নি, তারপর তো তিনি চলেই গেলেন।
মাঝে মাঝে হুমায়ূন ফরীদির বই দেওয়ার বিষয়টি শুটিংয়ে বলি। মনে হয় তিনি আছেন। একবার তৌকীর আহমেদের শুটিংয়ের সেটে বললাম। কেন বললাম? তৌকীর ভাই কঠোরভাবে বললেন, সোনিয়া মুর-এর বইটি বিপাশা আপার। হুমায়ূন ফরীদি নিয়ে এসেছিলেন, আর ফেরত দেননি। আমাকে বইটা ফেরত দিতে হবে। বই ফটোকপি করলাম, বাঁধাই করলাম, ফেরত দিলাম। স্যার বলেছিলেন যার দরকার তাকে দিতে। বইয়ের আসল মালিকের দরকার, দেওয়া আমার কর্তব্য।
স্তানিস্লাভস্কির বই নাড়াচাড়া করি, কিছু বুঝি, বেশিরভাগই বুঝি না। তিনি থাকলে তার পেছন পেছন ঘোরা যেত বুঝে নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্য, তিনি নেই।
কেটে গেল কিছু বছর। জীবনে নতুন ঘটনা যোগ হলো। হুমায়ূন ফরীদির বন্ধু, বাংলাদেশে থিয়েটার ও শিক্ষা প্রদানে যিনি বিস্ময়কর, সৈয়দ জামিল আহমেদের কাছে কর্মশালা করার সুযোগ হলো। তার কর্মশালার অগণিত বইয়ের একটি স্তানিস্লাভস্কি। এই সৌভাগ্য আমি কোথায় রাখি?
আমার বর একদিন বাসায় দুটো বাংলা থ্রিলার নিয়ে এল। বরের কর্মসূত্রে বই উপহার দেওয়া ব্যক্তির সাথে আমি পরিচিত। আমাকে দুরন্ত টিভির একটা অনুষ্ঠানে দেখেছিলেন। যেখানে একটি এনজিও পার্টনারশিপ ছিল, তখন তিনিও সেই এনজিওতে কর্মরত ছিলেন।
১৯৯৭ সালে হুমায়ূন ফরীদি একটা চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। চলচ্চিত্রের নাম ‘পালাবি কোথায়’....
আমার মনে ছিল অনুষ্ঠানের কথা কিন্তু সেই ব্যক্তি যে হুমায়ূন ফরীদির সুযোগ্য কন্যা দেবযানী তা আমার জানা ছিল না। পৃথিবী গোল। স্যার এবং তার কন্যার হাত দিয়ে আমাদের কুটিরে বই এসেছে। কোনোদিন সুযোগ পেলে দেবযানীকে বইঘরে নিয়ে যদি বলতে পারতাম যা মন চায় তুলে নেন।
হুমায়ূন ফরীদির দেওয়া বইগুলো এখনো খুললে মনে হয় এই বই তিনি পড়েছেন, চর্চা করেছেন, তার স্পর্শ আছে। কোনোদিন ওপারে দেখা হলে তিনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন ‘এমন অমূল্য সম্পদ হাতছাড়া করা যায়?’, তাহলে খুব মুশকিল হবে। এইরকম টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে বেড়ায়, তার কথা মনে পড়লে।
হুমায়ূন ফরীদির একটা টিভি নাটক দেখেছিলাম। নাটকের নাম দ্বিতীয় জন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও পরিচালনা। চমৎকার পাণ্ডুলিপি। তিনি আর সুবর্ণা মুস্তাফা ছিলেন প্রধান চরিত্রে। বেশ পুরোনো নাটক। এই দুজন পুরোটা সময় দর্শকদের আটকে রাখলেন। নাটকটা ইউটিউবে আছে। সবাইকে দেখার অনুরোধ জানাই।
১৯৯৭ সালে হুমায়ূন ফরীদি একটা চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। চলচ্চিত্রের নাম ‘পালাবি কোথায়’। সেই চলচ্চিত্রে তিনি ভিলেন হয়েছিলেন। ছবিটি কমেডি জনরার, তবে ১৯৯৭ সালে তৈরি নারীকেন্দ্রিক ছবিটি সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল। এই ছবিটিও ইউটিউবে আছে। বিচিত্র চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে গেছেন।
আরও পড়ুন
বাণিজ্যিক আর বিকল্প ধারা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। ‘হুলিয়া’, ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমুজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’, ‘আঞ্জুমান’, ‘বিচার হবে’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘শুধু তুমি’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’, ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘রূপকথার গল্প’, ‘আহা!’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘মেহেরজান’ অন্যতম।
তিনি ছিলেন অভিনেতা কিন্তু কথা বলতেন দার্শনিকের মতো। তার কথা এখনো আমার কানে বাজে। তিনি বলতেন—তুমি এমন কিছু আশা করবে না যা তোমার নাগালের বাইরে। নাগালের বাইরে যা, তা যখনই তুমি আশা করবে, সেটা হবে দুরাশা। দুরাশাটা করতে নেই। আশা করো, যা তোমার ক্ষমতার ভেতরে আছে, যা তুমি অর্জন করতে পারবে, যা তুমি গ্রহণ করতে পারবে। ওইটুকু আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে।
এমন দার্শনিক চিন্তা লালন করা মানুষটি পরম আন্তরিক ছিলেন। তার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
মৌটুসী বিশ্বাস ।। অভিনেত্রী