ছবি : সংগৃহীত

ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের দেখা মেলে বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণহানি নেহাত কম নয়। প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়।

বাংলাদেশ ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকার আকৃতি ফানেলের মতো হওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সমুদ্র তীরবর্তী জেলা—কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলাতে সবচেয়ে বেশি।

ঘূর্ণিঝড় রেমাল (Cyclone Remal) আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায়। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের। বাতিল হয়েছে বিমানের বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট। ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি, সহায়তা ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হলেও মানব জাতির বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা স্থবির হয়ে যায় প্রকৃতির রূঢ় আচরণের কাছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে মানুষ হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে সাগর মহাসাগরের সীমাহীন জলরাশির তলদেশ দমিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ শেষে যখন মঙ্গল গ্রহে বসবাসের চিন্তায় দিশেহারা ঠিক তখনো পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা ও উদ্ধারের সঠিক পদ্ধতি তৈরিতে পুরোপুরি সফল নয় বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী তার নিজ কক্ষপথে নিজের খেয়ালেই চলছে।

দক্ষিণ আটলান্টিক ও দক্ষিণ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ছাড়া বাকি সমগ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র অঞ্চলে প্রায়ই ভয়ানক বায়ুমণ্ডলীয় দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড় ঘটিত জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণ যোগ হলে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা আরও বেড়ে গিয়ে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে।   

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় রেমাল ২৬ মে ২০২৪ মধ্যরাতে পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ এবং বাংলাদেশের মংলা বন্দর অন্যান্য উপকূল এলাকায় আছড়ে পড়েছে। এই বছর বঙ্গোপসাগরে এটিই হবে প্রথম প্রাক-মৌসুমি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হলেও মানব জাতির বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা স্থবির হয়ে যায় প্রকৃতির রূঢ় আচরণের কাছে।

ঘূর্ণিঝড় কর্পূর এলাকায় আঘাত হেনেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি কী হয়েছে এই সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ নিয়ে প্রকাশিত খবরের সংখ্যা নেহায়েত নগণ্য। এই বিষয়ে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। কীভাবে এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম রেমাল হলো।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই। ২০০০ সালের আগে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হতো না। এরপর থেকে ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার রীতি চালু করে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলো। ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) অধীন জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী ১৩টি দেশের আবহাওয়াবিদদের সংস্থা এস্কেপ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়ে থাকে।

নাম ঠিক করার সময় বেশকিছু জিনিস মাথায় রাখতে হয় যেমন কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আঘাত করে এমন কোনো নাম গৃহীত হবে না। একবার ব্যবহার করা নাম আর ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিটি দেশ নাম প্রস্তাব করার সুযোগ পায়। ১৩টি দেশের কাছে আগাম পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।

ঘূর্ণিঝড়কে চিহ্নিত করার জন্যই নামকরণ প্রথা চালু করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের নাম গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে মনে রাখা সহজ করে তোলে। এই নামের সাহায্যে গণমাধ্যম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, গবেষক বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষরা যেন সহজেই একে চিনতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই এই নামকরণ।

নামের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় এটি আলাদা ঘূর্ণিঝড়। এই ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে, প্রস্তুতি নিতে, বিভ্রান্তি দূর করতে নাম কাজে লাগে। ঘূর্ণিঝড় আসলে কোনো অঞ্চলের সাইক্লোনিক সিস্টেম (Cyclonic System)। বিশ্বের সব দেশেই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের একইভাবে নামকরণের রীতি চালু আছে।

ঘূর্ণিঝড় ঘটিত জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণ যোগ হলে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা আরও বেড়ে গিয়ে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে।  

আরবি ভাষায় রেমাল নামের অর্থ—‘বালি’। নামটা বেছে নিয়েছে ওমান। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের আদর্শ নিয়ম অনুসারে এই নাম বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ওমান। 

আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা এবং দুর্যোগ প্রশমনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, ডব্লিউএমও ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কমিটি (পিটিসি) তৈরি হয় ১৯৭২ সালে। মোট আটটি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে তৈরি হয় পিটিসি। এই দেশগুলো হলো—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ওমান এবং থাইল্যান্ড।

২০০০ সালে ওমানের মাস্কটে অনুষ্ঠিত হয়, পিটিসির ২৭তম অধিবেশন। পিটিসি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করতে রাজি হয়। প্যানেলের প্রতিটি দেশ তাদের সুপারিশ পাঠানোর পর, পিটিসি তার তালিকা তৈরি করে। তারপর ২০০৪ সালে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে।

পিটিসি ২০১৮ সালে, ইরান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেনকেও তাদের সংগঠনভুক্ত করে। ২০২০ সালের এপ্রিলে, ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সদস্য ১৩টি দেশের প্রত্যেক সদস্য ১৩টি করে নাম প্রস্তাব করেছিল। সেই তালিকা থেকেই বর্তমানে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হচ্ছে।

কোন দেশে এই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে বা আঘাত হানবে তার ওপর নামকরণ বিবেচনা করা হয় না। বরং, দেশগুলোর পরপর নাম অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়। যেমন ঘূর্ণিঝড় ‘নিসর্গ’-এর নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ। আছড়ে পড়েছিল মহারাষ্ট্রে। ভারত নাম দিয়েছিল ‘গতি’। আছড়ে পড়েছিল সোমালিয়াতে। ইরান নাম দিয়েছিল ‘নিভার’ আর আঘাত হেনেছিল তামিলনাড়ুতে।

ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হেনেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেকটাই সফলতা অর্জন করেছে বলে আমরা বিগত সময়গুলোয় দেখেছি। যদিও এই সফলতা আপেক্ষিক। বরং আমাদের বাঁধ নির্মাণজনিত দুর্নীতির বিষয় বেশি পরিলক্ষিত হয় গণমাধ্যমে।

বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আর্থিক জোগান ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তাই আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, কয়েক দশক ধরে ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমে এসেছে। এরপরও অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির কাছে হার মেনে যায় মানুষ।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com