চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক?
সিদ্দিকুরের কথা মনে আছে?
ওই যে ঢাকার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর পরীক্ষার রুটিনের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই শাহবাগে সেই আন্দোলনে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
মিছিলে পুলিশ বাঁধা দেয়। বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। টিয়ার শেল ছোঁড়ে পুলিশ। শেলের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সিদ্দিকুর রহমান। তার ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বাম চোখের দৃষ্টিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভয়াবহভাবে। বাম চোখ রক্ষায় ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এবং ভারতের শঙ্কর নেত্রালয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। দৃষ্টির বিনিময়ে সিদ্দিকুর রহমানকে সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছিল, এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের টেলিফোন অপারেটর পদে।
সিদ্দিকুর যখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি, এক বিকেলে গিয়েছিলাম তাকে দেখার জন্য এবং খবরের রসদ জোগাড়ের আশায়। তা ছিল এক বিকেল ছোঁয়া শেষ দুপুরের কথা। চোখে ব্যান্ডেজ সিদ্দিকুর সাংবাদিক এসেছে শুনে উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন। বড় ভাই নায়েব আলী তাকে আগলে রেখেছিলেন হাসপাতালে।
আরও পড়ুন
এক পর্যায়ে সিদ্দিকুর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ভাই আমার চোখের দৃষ্টিটা ফিরিয়ে দেন ভাই। আমার বাবা নাই। এই ভাই আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসছে। এখন আমার কী হবে? আমার পরিবারের কী হবে? পাশ থেকে সিদ্দিকুরের ভাই বলে উঠেন—ভাইরে তুই কোনো চিন্তা করিস না। ভিটেমাটি যা আছে, সব বেচে হলেও তোরে লেখাপড়া করাবো।
সিদ্দিকুর রহমানদের পরিবারের কথা একটু বলি। ময়মনসিংহের তারাকান্দার ঢাকেরকান্দা গ্রামের সিদ্দিকুরদের বাবা মারা গেছেন। মা কিষানি। ভাই নায়েব আলী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তাদের হাড়ভাঙা শ্রমে সিদ্দিকুরকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন।
ধান ভানতে শিবের গান অনেক হলো। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য আন্দোলন করছেন বেশকিছু শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশী তরুণ তরুণী। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বারো বছর ধরে এই আন্দোলন চলছে। তবে এই আন্দোলন বেশকিছুটা জোরদার হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। আন্দোলনকারীরা বলছেন, সেই সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।
আন্দোলনকারীরা মিছিল বিক্ষোভ তো করছেনই। সেই সঙ্গে সার্টিফিকেট ফটোকপি করে কফিন মিছিল, অনশন ইত্যাদি নানা কর্মসূচিও করছেন। কিন্তু তাদের দাবির পক্ষে সরকারি তরফে কোথাও কোনো সমর্থন পাননি এখন পর্যন্ত। তবে সম্প্রতি তা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজেদের দাবি দাওয়া জানিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে সুপারিশ পত্র দিয়েছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন এই মুহূর্তে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কিংবা চাকরি প্রত্যাশীরা তাদের দাবি থেকে সরে আসেননি। আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো।
এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা অযৌক্তিকতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি কথা হচ্ছে অনেক। কিন্তু অন্যসব আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনেও পুলিশকে মারমুখী আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন গেলো সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে গণভবন অভিমুখে যাত্রা করলে শাহবাগে পুলিশ বাঁধা দেয়। এখান থেকে আটক করা হয় ১৪/১৫ জনকে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় এই আন্দোলন থেকে আটক গ্রেফতারের খবর গণমাধ্যমে দেখা গেছে। কথা হলো একটা আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলন যতক্ষণ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে বল প্রয়োগ গ্রেফতার লাঠিচার্জের কী প্রয়োজন? সিদ্দিকুর রহমানের কথা বলছিলাম না? খুব কাছ থেকে ছোঁড়া টিয়ার শেলের আঘাতে সিদ্দিকুরের চোখ নষ্ট হয়ে গেলে পুলিশের ভাষ্য ছিল, ফুলের টবের আঘাতে সিদ্দিকুর আহত হয়েছেন! অথচ রাষ্ট্র কিন্তু ফুলের টবের আঘাতে চোখ নষ্ট হওয়ার জন্য সিদ্দিকুর রহমানকে চাকরি দেয়নি! চাকরি দিয়েছিল টিয়ারশেলের আঘাতের কারণেই।
আরও পড়ুন
বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, অনেক দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর থেকে ৪৫ বছর। ৩২ বছর পর্যন্ত। এরমধ্যে ১৬২টি দেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর। কোনো কোনো দেশে এটি উন্মুক্ত। প্রতিবেশী অন্তত ৮ দেশে এই বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর।
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। আফগানিস্তানে বয়সসীমা ৩৫ বছর। আর মালদ্বীপে সর্বোচ্চ ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকরির আবেদন করা যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে, ভারতে রাজ্যভেদে ও চাকরির ধরন অনুযায়ী আবেদনের বয়সসীমা ৩২-৪২ বছর পর্যন্ত। দেশটিতে প্রশাসনিক সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম ২১ থেকে ৩২ বছর বয়স হতে হয়। তবে কোটায় ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করা যায়। অনগ্রসর শ্রেণির জনগণ ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। আর দলিতরা ৩৭ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন।
নেপালে গেজেটেড ও নন গেজেটেড পদে আবেদন করার ক্ষেত্রে পুরুষের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। তবে নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ৪০ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। গেজেটেড পদ শাখা কর্মকর্তা, উপ-সচিব এবং যুগ্ম সচিব বা এই ধরনের পদে ন্যূনতম ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। এই পদে মহিলা ও প্রতিবন্ধীরা ৪০ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন।
শূন্য পদের ক্ষেত্রে উপ-সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করার বিধান রয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক স্তরের পদে সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। অফিসার পদে সর্বনিম্ন ২১ ও সর্বোচ্চ ৪৫ বছরের ব্যক্তিরাও আবেদন করতে পারেন।
একটা সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চরম সেশন জট ছিল। তখন শিক্ষা জীবন শেষ হতে অনেক সময় লাগতো। ফলে অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরির আবেদনের বয়সসীমার একেবারে শেষপ্রান্তে চলে যেতেন। তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশন জট প্রায় নেই।
শ্রীলঙ্কায় স্নাতক পাস করা বেকাররা সরকারের যেকোনো কর্মসূচির অধীনে ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। আগে এই বয়সসীমা ছিল ৩৫ বছর। তবে সরকারি চাকরির সব ক্যাটাগরির জন্য এই বয়সসীমা প্রযোজ্য নয়।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর। পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে ২১ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। তবে কোটার ক্ষেত্রে ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন চাকরি প্রার্থীরা। তবে দেশটির বেলুচিস্তান রাজ্য সরকার বয়সসীমা ৪৩ বছর করেছে। আফগানিস্তানে বয়সসীমা ৩৫ বছর। আর মালদ্বীপে সর্বোচ্চ ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকরির আবেদন করা যায়।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। আন্দোলনকারীরা বলছেন, সেই সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। এসব বিবেচনায় আন্দোলনকারীরা বলছেন, বাংলাদেশেও এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত।
আরও পড়ুন
আবার উল্টো যুক্তিও আছে। অনেকে বলছেন, একটা সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চরম সেশন জট ছিল। তখন শিক্ষা জীবন শেষ হতে অনেক সময় লাগতো। ফলে অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে চাকরির আবেদনের বয়সসীমার একেবারে শেষপ্রান্তে চলে যেতেন। তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশন জট প্রায় নেই বললেই চলে। একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পড়াশোনা শেষ করে বের হতে পারেন। সুতরাং বয়স বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
ধরে নিলাম, সবার যুক্তিই ঠিক আছে। কিন্তু এসবের মধ্যেই একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের হোক এটিই সবার প্রত্যাশা। আরেকটা কথা, বিভিন্ন সময় আমরা গণমাধ্যমে খবর দেখি—লোকবলের অভাবে সেবা দিতে পারছে না অমুক সরকারি সংস্থা। অমুক প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ এতগুলো ইত্যাদি। কথা হলো, দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তো কম না। বেকারও আছেন অনেক। তারপরও আমাদের বিভিন্ন দফতরে পদ খালি বা শূন্য পড়ে থাকে কেন? বিষয়টাও নিশ্চয় কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন।
খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী