ছবি : সংগৃহীত

বুদ্ধ পূর্ণিমা সারা বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বুদ্ধ পূর্ণিমা বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এক মহান দিন। এই দিনে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। মহাজ্ঞানী বুদ্ধত্ব লাভ করেন এবং একই দিনে বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এই তিথিকে বলা হয় বৈশাখী পূর্ণিমা, যা আজ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে (Vesak Day) হিসেবে পালন করা হয়।

বৈশাখ মাসের এই তিথিতে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল বলে আজ বৌদ্ধদের অতি পবিত্র একটি দিন হিসেবে তা পালন করা হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এই দিনে আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি গৌতম বুদ্ধ ভারতবর্ষের তৎকালীন কপিলাবস্তু ও দেবদহ নগরের মধ্যবর্তী লুম্বিনী কাননে (বর্তমানে নেপালে) মাতা রানী মায়াদেবীর পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে শালবৃক্ষের নিচে জন্মগ্রহণ করেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে ৩৫ বছর বয়সে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধি বৃক্ষমূলে কঠোর সাধনা বলে তিনি বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেন অর্থাৎ তিনি জাতিস্মর। জ্ঞান, দিব্যচক্ষু জ্ঞান ও সর্বজ্ঞতা লাভ করেন তিনি।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে ৮০ বছর বয়সে একই দিনে ৪৫ বছর দুঃখ মুক্তির ধর্ম প্রচার করে কুশীনগরে যুগ্মশাল তরুমূলে চিরনির্বাপিত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন অর্থাৎ তিনি দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। পৃথিবীতে তিনি আর জন্মগ্রহণ করবেন না।

গৌতম বুদ্ধের পিতার নাম ছিল রাজা শুদ্ধোধন ও গৃহী নাম ছিল সিদ্ধার্থ। ২৫২৭ বছর আগে ভারতবর্ষে যখন ধর্মহীনতা, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন বিশ্বাস, শ্রেণি বৈষম্য, কুসংস্কার, প্রাণী হত্যা বেড়ে গিয়েছে তখন শান্তি, মৈত্রী, অহিংসা, সাম্য ও মানবতার বার্তা নিয়ে মহামতি বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে।

গৌতম বুদ্ধ জীবনের প্রগাঢ় চার আর্যসত্য আবিষ্কার করলেন—জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি আছে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে।

তিনি প্রচার করেন এই জীবজগৎ অনিত্য, দুঃখ অনাত্মাময়, প্রাণী মাত্রই প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। অস্থায়ী বা অনিত্য, মরণশীল এবং কার্যকারণের অধীন। তিনি জীবনের প্রগাঢ় চার আর্যসত্য আবিষ্কার করলেন—জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি আছে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে।

দুঃখ নিবৃত্তিই হলো নির্বাণ লাভ করা। আর এই নির্বাণ লাভের ৮টি পথ আছে। তাকে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। যেমন—সম্যক বা সঠিক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। এই পথ পরিক্রমায় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাই নির্বাণ লাভের একমাত্র উপায়।

‘সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু’ অর্থাৎ ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’—পৃথিবীর সবচেয়ে পরম, মহৎ বাণী তিনি প্রচার করেছেন। শুধু মানুষের নয়, পৃথিবীর সব প্রাণ ও প্রাণীর প্রতি, প্রেম, ভালোবাসা, অহিংসা, ক্ষমা, মৈত্রী, দয়া, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ, প্রীতি, সাম্য, সম্প্রীতির কথা বলেছেন।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯৯৯ সালে ৫৪/১১৫ রেজুলেশনের মাধ্যমে এই দিনকে আন্তর্জাতিক ভেসাক ডে (International Day of Vesak) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ‘ভেসাক ডে’ হিসেবে পালন করে আসছে।

নির্বাণ লাভের ৮টি পথ আছে। তাকে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। যেমন—সম্যক বা সঠিক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি।

বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র এই দিনকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে—বুদ্ধ পূর্ণিমা, লাওসে—বিশাখ পূজা, ইন্দোনেশিয়ায়—হারি ওয়াইসাক ডে, মালয়েশিয়ায়—ওয়েসাক ডে, মিয়ানমারে—ফুল ডে অব কাসন, সিঙ্গাপুরে—হারি ভেসাক ডে নামে পালন করে থাকে। আবার কেউ বুদ্ধ জয়ন্তী দিবস হিসেবেও পালন করে থাকে।

ফিলিস্তিনে আজ চরমভাবে মানবতা বিপন্ন হচ্ছে, অশান্তির এই পৃথিবীতে বুদ্ধের মৈত্রী, সংহতি, সাম্য, মানবতা ও শান্তির বাণী বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আজও প্রাসঙ্গিক।

বিশ্ব আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলাবদ্ধতা, বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন এই সবুজ গ্রহের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

গৌতম বুদ্ধই প্রথম বৃক্ষকে এক ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট জীবরূপে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধ ছিলেন বিশুদ্ধ পরিবেশবাদী দার্শনিক। পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তাই বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ বৃক্ষের পদমূলে বিশুদ্ধ পরিবেশে তা সংগঠিত হয়েছিল।

এই পবিত্র দিনে বৌদ্ধরা বিভিন্ন দেশে দেশে সব প্রাণীর সুখ, শান্তি কামনায় সমবেত হয়ে প্রার্থনা করেন। অশান্ত পৃথিবীতে, পরিবেশ সংরক্ষণে বুদ্ধের বাণী, নীতি ও আদর্শ, বিশ্ব মানবতার শিক্ষা, দর্শন, চিন্তা-চেতনা, ভাবনা সুন্দর, শান্ত, সাম্যময় পৃথিবী গড়ার বিকল্প নেই। সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।

অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া ।। চিকিৎসক, সংগঠক ও গবেষক