ছবি : সংগৃহীত

আমাদের দেশে জ্বালানি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। জ্বালানি ঘাটতি মেটানোর জন্য বাল্ক-এনার্জি আমদানি করতেই হবে, সেই ক্ষেত্রে খরচ বাঁচানোর জন্য আমাদের বিকল্প উৎসগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। তাছাড়া আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা আছে।

বায়ুকল বা উইন্ড এনার্জি নিয়ে আমাদের আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। কক্সবাজারের খুরুশকুলের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে আমাদের আগ্রহ আছে। এটা টেকসই হবে কি না অন্তত ২ বছরের তথ্য থেকে তা জানা যাবে। কারণ এতে করে ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনটা ভালো বোঝা যাবে। এটা সার্থক হলে, আমাদের আরও কিছু বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর প্রয়োজন হবে।

সেই সাথে অফ-শোর বা সমুদ্রের ভেতরে উইন্ডমিলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে হবে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। অ্যামোনিয়া ভেঙে বা পানির তড়িৎ-বিশ্লেষণে বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে। তবে উৎস-ভেদে এই হাইড্রোজেন আবার ব্লু, গ্রিন কিংবা গ্রে হতে পারে—এই রঙের অর্থ আছে, এর দ্বারা দূষণের মাত্রা বোঝায়।

অর্থাৎ হাইড্রোজেন তৈরি করতে গিয়ে আমরা বাড়তি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছি কি না তা দেখা দরকার। এই হাইড্রোজেনকে আমরা পাইপলাইনে সরবরাহ করতে পারি, গ্যাস জেনারেটরে কো-ফায়ারিং করতে পারি। হাইড্রোজেন দহনে শুধুই পানি নিঃসৃত হয় বিধায় এটা দূষণ মুক্ত। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে উৎসের হাইড্রোজেন প্রস্তুতিতে বাড়তি এনার্জি কত লাগছে, কিংবা পুরো চক্রে যতটুকু শক্তি খরচ হচ্ছে তার তুলনায় বেশি শক্তি প্রয়োজন হলো কি না। হলে, সেই হাইড্রোজেন বাঞ্ছনীয় হবে না।

দেখতে হবে, দেশের আর্থ-কাঠামো ও জ্বালানি-কাঠামো হাইড্রোজেন অর্থনীতিকে ধারণ করতে পারে কি না। আমাদের দূরপাল্লার বাল্ক-হেড নৌযানগুলো যদি হাইড্রোজেন-চালিত করা যায়, যেমন দূর-সমুদ্রের জাহাজগুলো এবং ট্রেন-পরিবহনকে যদি বিদ্যুতায়িত করা সম্ভব হয় তাহলে জ্বালানি সাশ্রয় এবং কার্বন-দূরীকরণে বড় পদক্ষেপ হবে। 

একই সাথে আঞ্চলিক গ্রিড নিয়ে আমাদের নজর বাড়ছে। এই বিষয়ে সরকারি আগ্রহ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নেপালি জলবিদ্যুতের অমিত সম্ভাবনা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। একই কথা ভুটানের জন্যও প্রযোজ্য। বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং ত্রিদেশীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে সেই বিদ্যুৎ বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে। এতে ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। কিন্তু তবু এটা দরকার।

একইসাথে পূবের দিকেও নজর রাখতে হবে। আসিয়ান (ASEAN) গ্রিড একটি অমিত সম্ভাবনার আশা দেয়। যদিও তা সুদূর পরাহত, তবুও। তার প্রথম এবং একমাত্র বাধা মিয়ানমার। দক্ষিণ এশিয়ায় যদি আমরা আঞ্চলিক গ্রিড স্থাপন করতে পারি, তবে সার্বিকভাবে আমাদের গ্রিডের কার্বন-ফুটপ্রিন্ট কমবে, কারণ সেই ক্ষেত্রে আমরা নেপাল-ভুটান-ভারতের জল এবং সৌর-বিদ্যুতের ব্যবহার দেখিয়ে ডিকার্বনাইজেশনের কথা বলতে পারি।

বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত গাড়ি পরিবহন খাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে, এর চার্জিং কাঠামো, ভোল্টেজের মাত্রা, খরচার হিসাব—তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, এসব নিয়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কী হচ্ছে তা পরিষ্কার না। ইভি বা ইলেট্রিক-ভেহিকেল পুরোমাত্রায় চালু হলে ডিজেল-নির্ভরতা কমলেও, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে।

আমাদের দেশে ইলেক্ট্রিসিটি ট্রেডিং খুলে দেওয়া যেতে পারে। একাধিক উৎপাদনকারী থেকে কম খরচে যদি ঢাকার বিদ্যুৎ আমরা ক্রয় করতে পারি, ক্ষতি কী? আত্মীকরণের পূর্বে এইসব ভবিষ্যতের সম্ভাবনা অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে, যা অন্য দেশে চলে সেইটা আমাদের ক্ষেত্রে নাও চলতে পারে। বিদেশের টেকনোলজি দেশের ব্যবহারযোগ্যতার কষ্টিপাথরে পরখ করে নিতে হবে।

বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত গাড়ি পরিবহন খাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে, এর চার্জিং কাঠামো, ভোল্টেজের মাত্রা, খরচার হিসাব—তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, এসব নিয়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কী হচ্ছে তা পরিষ্কার না। ইভি বা ইলেট্রিক-ভেহিকেল পুরোমাত্রায় চালু হলে ডিজেল-নির্ভরতা কমলেও, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে।

পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ যেহেতু চট করে পাওয়া যাবে না, আমার ভয় হয়, আমাদের সম্ভবত কয়লার দিকে কিছুদিন ঝুঁকতে হবে, অন্তত যতদিন না ক্লিন এনার্জি বাল্ক-লোড বহন করতে সক্ষম হচ্ছে। কয়লা সবাই ব্যবহার করে—চীন, ভারত, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা। আমরা কেন পারব না? জলবায়ুর দায় একা বাংলাদেশের নয়, যেখানে আমাদের জনপ্রতি নিঃসরণ যেকোনো পশ্চিমা মানুষের জনপ্রতি নিঃসরণের তুলনায় বিশ ভাগেরও কম।

জ্বালানি সংরক্ষণ, সরবরাহ, বণ্টন, জ্বালানি দক্ষতার উন্নয়ন, জ্বালানি সচেতনতা—এসব বিষয়ে আমাদের স্মার্ট পদক্ষেপের অভাব আছে। কারণ আমাদের সিদ্ধান্তগুলো তথ্য নির্ভর হয় না। জ্বালানি দক্ষতার খাতগুলো আমাদের ক্ষেত্রে খুবই নাজুক অবস্থায় আছে—ভবন নির্মাণ, অঞ্চল পরিকল্পনা, যান্ত্রিক দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে যানবাহন ও বিদ্যুৎ ব্যবহার ইত্যাদি।

রুফটপ সোলারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে আমাদের প্রয়োজন সরকারি নীতি প্রণয়ন। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন আমদানি শুল্কের বিষয়ে কথা বলে আসছেন। শুল্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা খুব পরোক্ষে একটা খাতের উত্থান কিংবা পতন ঘটায়। ফলে সরকার যদি চান দেশে সোলারের জয়জয়কার হোক, তবে তাকে শুল্ক প্রণয়নে বিচক্ষণ হতে হবে।

একইসাথে জমি ব্যবস্থাপনা সোলার ইলেক্ট্রিসিটির জন্য গলার কাঁটা হতে যাচ্ছে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ আমাদের কী পরিমাণ জমি দেবে এবং তাতে কি আমরা সোলার পার্ক করতে পারব কি না তা সম্পর্কে খুব নির্ভরযোগ্য কোনো সুরাহা আমার চোখে পড়েনি।  

আমাদের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার যার অংশ হিসেবে জাপান সরকারের সাহায্যে প্রণীত হয়েছে একটি প্ল্যান—IEPMP। এর খসড়াটি আমরা পেয়েছি। এসব পরিকল্পনায় দেশীয় বিশেষজ্ঞ যুক্ত করার প্রয়োজনের কথা আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলছি।

জ্বালানি এমনই একটা বিষয় যার কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। দিন আনি, দিন খাই পদ্ধতিতে চললে আমরা ২০৪১ সালে নিজেদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত দেখতে পাব।

দেশের বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী-অর্থনীতিবিদ-নীতিনির্ধারকদের নিয়ে একটি কোর গ্রুপ বা টাস্ক ফোর্স থাকা প্রয়োজন এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও কাঠামো প্রয়োজন। তারা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করবেন, কম্পিউটার মডেল নির্মাণ করবেন এবং দেখবেন বিভিন্ন কল্পিত সিনারিওতে জ্বালানির অবস্থা কী রকম হচ্ছে। এর জন্য চাই মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা, একটি যুগোপযোগী ডাটা সেন্টার এবং কোর গ্রুপ গঠন এবং তাদের লালন।

মন্ত্রণালয়ের এখনকার মনোযোগ হলো তাৎক্ষণিক চিন্তায় বা ইমিডিয়েট নিড অ্যাসেসমেন্টের দিকে। এই মুহূর্তে কী দরকার, আগামী কয়েক মাসে কী কী চলবে-তা নির্ধারণ করা। খুব বেশি ভবিষ্যৎ তারা মাথায় নিতে অনাগ্রহী। কিন্তু জ্বালানি এমনই একটা বিষয় যার কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। দিন আনি, দিন খাই পদ্ধতিতে চললে আমরা ২০৪১ সালে নিজেদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত দেখতে পাব।

এনার্জি ট্রানজিশন বা জ্বালানি রূপান্তরের ব্যাপারে আমাদের অংশীদারিত্বও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাৎক্ষণিক সমাধান স্টেরয়েডের মতো, এটা আপৎকালীন ব্যথা নিরসন করবে, কিন্তু অন্তর্গত অসুখ সারবে না। জ্বালানি খাতের এই অন্তর্গত অস্বস্তি কাটাতে প্রয়োজন জ্বালানি বিষয়ক সচেতনতা, বিশেষজ্ঞের এবং সাধারণের।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের প্রয়োজন একটি সার্বিক আয়োজন, একটি অংশীদারিত্বমূলক গবেষণা-ভিত্তিক আউটলুক প্রয়োজন। যেখানে স্মার্ট গ্রিড, আধুনিক ব্যাটারি প্রযুক্তি, গ্রিড ব্যবস্থাপনা, এনার্জি-মডেল ভিত্তিক ফোরকাস্ট, বাস্তব অবস্থা যাচাইয়ের প্রেক্ষিতে ট্যারিফ নির্ধারণ প্রয়োজন।

হাইড্রোজেনসহ বিকল্প জ্বালানি উৎসের সন্ধান-গবেষণা-সম্ভাব্যতা-খরচ যাচাই, সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়করণ, জ্বালানি দক্ষতায় মনোযোগ দেওয়া—যন্ত্রে-ভবন নির্মাণ-অঞ্চল পরিকল্পনায়, পরিবহন খাতের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকরণে, সেচ পাম্পকে মিনি বা কমিউনিটি সোলার গ্রিডের আওতায় আনা, এলএনজি / ক্রুড / কয়লার আধুনিক সরবরাহ-সঞ্চয়-বণ্টন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পুরো জ্বালানি ব্যবস্থাকে আধুনিক সমন্বিত ডাটা-ম্যানেজমেন্টের আওতায় আনা, দক্ষিণ বঙ্গে পরমাণু শক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই, আঞ্চলিক গ্রিড বিষয়ে আগ্রাসী পন্থা অবলম্বন, এবং মাধ্যমিক স্কুলে জ্বালানি-সচেতনতা সৃষ্টি। এর পাশাপাশি প্রয়োজন জ্বালানি-শিক্ষিত প্রকৌশলী-প্রযুক্তিবিদ সৃষ্টি করা। এর জন্য লাগবে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র বা ইন্সটিটিউট এবং প্রচুর পরিমাণে মানসম্পন্ন Technical and vocational education and training (TVET) কেন্দ্র। আসুন জ্বালানি শিক্ষিত হই, দেশ গড়ি।

ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়