উপজেলা নির্বাচন
ভোট আছে, ভোটার নাই!
বাংলাদেশে এখন কোনো নির্বাচন এলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। একসময় বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ছিল উৎসব। জাতীয় নির্বাচন তো বটেই, স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেও উৎসবের বান ডাকতো গ্রামে-গঞ্জে। ছেলেবেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গ্রামের উঠানে উঠানে মিছিল হতো।
‘নাইচ্যা নাইচ্যা কইয়া যাই, অমুক মার্কায় ভোট চাই’ আমরা নেচে নেচে এই স্লোগান দিতাম। এখন ভাবলে হাসি পায়, আমরা ছেলেমানুষেরা সব প্রার্থীর মিছিলেই অংশ নিতাম। আসলে প্রার্থী নয়, মিছিলের-স্লোগানের ছন্দটাই আমাদের টানতো।
বিজ্ঞাপন
আমরা অতকিছু বুঝতাম না। বড়দের দেখতাম, প্রার্থীদের পক্ষে নানা বৈঠক করতো, বিকালে বাজারে চায়ের দোকানে ধুম আড্ডা চলতো। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। নির্বাচনের দিন ভোটারদের আনার জন্য প্রার্থীরা রিকশার ব্যবস্থা করতো।
আরও পড়ুন
বিভিন্ন ক্যাম্পে চা-নাস্তার ব্যবস্থাও থাকতো। যেহেতু স্থানীয় সরকারে প্রার্থী বেশি, তাই সব প্রার্থীই নিজ নিজ ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করতো। তাতে কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের লাইন লম্বা হতো।
এখনো দেশে নির্বাচন হয়। তবে নির্বাচন থেকে হারিয়ে গেছে উৎসবের আমেজটা। নির্বাচন, গণতন্ত্র হলো বাইসাইকেলের মতো। যার পক্ষ থাকবে, প্রতিপক্ষ থাকবে, মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। সাইকেলের দুটি চাকা সচল থাকলেই তা চলতে পারে। এক চাকায় সাইকেল মুখ থুবড়ে পড়ে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক চাকার সাইকেলের মতো। এখনো দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে নির্বাচন হয়। ভোট আছে, কিন্তু সেই ভোট নিয়ে ভোটারদের আর কোনো আগ্রহ নেই।
এখন দেশে চলছে উপজেলা নির্বাচন। চার ধাপে ৪৮১টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে। ৮ মে ২০২৪, প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হয়েছে। এই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাই ছিলেন। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনও করেছেন। কিন্তু ঘাটতি ছিল ভোটারের।
ভোট গ্রহণের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেছেন, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ৩০ থেকে ৪০—পার্থক্যটা ১০ শতাংশের। আমি যদি সর্বোচ্চটাই ধরে নেই, তাও বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত চারটি উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এখনো দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে নির্বাচন হয়। ভোট আছে, কিন্তু সেই ভোট নিয়ে ভোটারদের আর কোনো আগ্রহ নেই।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮.৩২ শতাংশ, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪০.২২ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। তার মানে ভোটের ব্যাপারে ভোটারদের আগ্রহ ক্রমশই কমছে।
কেন কমছে? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দায়ী করেছেন, ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ততা, কোথাও কোথাও ঝড়-বৃষ্টিকে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও জানেন, এসবই অজুহাত মাত্র। আসল কারণটা তিনিও জানেন। কিন্তু বলতে পারবেন না। নির্বাচন মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নির্বাচন মানেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, নির্বাচন মানেই ভোটারদের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু সেই স্বাধীনতাটাই আর নেই ভোটারদের।
আরও পড়ুন
বিএনপি অনেকবছর ধরেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। ফলে নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটাই হয়ে পড়েছে একতরফা, একদলীয়। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সেই আমেজটাই হারিয়ে গেছে।
তাই তো কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক পড়ে, কখনো রাতের ভোটের অভিযোগ আসে, কখনো ডামি প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরির চেষ্টা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষও জানে, ভোটের আসলে নামে কী হয়। সেই কারণে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই।
কোনো খেলার ফলাফল যদি আপনি আগে জেনে যান, তাহলে সেই খেলায় অংশ নেওয়া বা দেখার আগ্রহ আপনার থাকবে না। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে ভোটের আগেই নির্বাচনের ফলাফল সবাই জেনে যান। তাই তো নির্বাচনের চেয়ে মনোনয়নের ব্যাপারেই সবার আগ্রহ বেশি।
...আসল কারণটা তিনিও জানেন। কিন্তু বলতে পারবেন না। নির্বাচন মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নির্বাচন মানেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, নির্বাচন মানেই ভোটারদের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু সেই স্বাধীনতাটাই আর নেই ভোটারদের।
সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই জয়ের দিকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হয়, সমঝোতা হয়। তাই ভোটের দিনের উত্তেজনাটা আর থাকে না। যেমন এবারের উপজেলা নির্বাচনে মূল আগ্রহ ছিল এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন বা তাদের সমর্থকদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হটিয়ে মন্ত্রী-এমপির প্রার্থীরাই বেশিরভাগ উপজেলায় জয় পেয়েছেন। অবশ্য এমনটাই হওয়ার কথা ছিল।
একবার রাজা দুধ দিয়ে একটি পুকুর বানাতে চাইলেন। রাজ্যের সবাইকে বললেন, একপাত্র করে দুধ নিয়ে আসতে। সবাই ভাবলো অন্যরা তো দুধই আনবে, আমি পানি নিলে কেউ ধরতে পারবে না। এভাবে সবাই পানি নিয়ে গেল। রাজার দুধের পুকুর আর হলো না।
এখন নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটারদের হয়েছে সেই দশা। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও আর ভোট কেন্দ্রে যান না। অন্তত আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কেন্দ্রে গেলেও ভোটের হার আরও ভালো হওয়ার কথা।
আরও পড়ুন
আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ভাবেন, আমি যাকে ভোট দেবো, সেই তো জিতবে। তাহলে আর কষ্ট করে ভোট দিতে যেতে হবে কেন। এই ভাবনায় ভোটের লাইনে দুধের পুকুরের দশা হয়।
কত শতাংশ ভোটার ভোট দিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, তার কোনো মাপকাঠি নেই। সংবিধান বা নির্বাচনী আইনের কোথাও এই ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। তাই ৩০-৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিলেও নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। তবে কোনো এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার কেন্দ্রে না গেলে তার নৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
নির্বাচন কমিশন, সরকার, আওয়ামী লীগ যতই ডাকুক; ভোটাররা কেন্দ্রে আসবে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে, সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরলে; ভোটাররা এমনিতেই দলে দলে কেন্দ্রের লাইনে দাঁড়াবেন। গাছের গোঁড়া কেটে আগায় পানি দিয়ে লাভ নেই।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ