ভারতে করোনা বৃদ্ধি ও আমাদের প্রস্তুতি
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতকে গ্রাস করে নিয়েছে। ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স যেকোনো জায়গায় পরিবর্তিত হতে পারে। যার ফলে নতুন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিত করেছে। ভারতে বর্তমান যে অবস্থা, সেখানে করোনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ডাবল ভ্যারিয়েন্ট বি.১.৬১৭ এর উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে গত অক্টোবরে। নতুন এই ধরনে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে পাওয়া মিউটেশনেরও সংযোজন রয়েছে।
অন্যদিকে অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি, পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘকালব্যাপী হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন, আইপিএল খেলা কিংবা নিয়ম না মানার সংস্কৃতি সব মিলিয়ে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে এবং তিন লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতালগুলোতে রোগী বৃদ্ধির চাপে অক্সিজেন সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে অক্সিজেন না পেয়ে ২২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, কেরালাসহ নানান অঙ্গরাজ্যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে ভারত সরকারকে বলা হয়েছে, চুরি করে হোক বা ভিক্ষা করে হোক অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। এমন অবস্থায় সৌদি আরব, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভৃতি দেশ অক্সিজেন পাঠিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের সঙ্গিন অবস্থায় তাদের সঙ্গে বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশের যাতায়াত আপাতত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যেহেতু বাংলাদেশের তিন পাশেই ভারতের অবস্থান এবং প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ স্থলবন্দরগুলো দিয়ে যাতায়াত করে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গেই করোনার নতুন ধরনটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অতএব, ধারণা করছি ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টটি আমাদের দেশেও ইতোমধ্যে এসে থাকতে পারে। গণমাধ্যমে জানা গেল, ভারত ফেরত দশজন করোনা রোগী যশোর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, যাদের পুনরায় পুলিশ ধরে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য করেছে। তাই, সন্দেহটি একেবারে অমূলক নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। এপ্রিলের গত দুই সপ্তাহে প্রায় হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে এবং সর্বোচ্চ সংক্রমিত হয়েছে সাত হাজারের বেশি। যদিও লকডাউনের ফলে সংক্রমণ কিছুটা স্বস্তিতে নেমে এসেছে বর্তমানে। তবে পিকে থাকার সময় আমাদের দেশেও হাসপাতালে আইসিইউ এবং বেডের সংকটসহ অক্সিজেন ও ওষুধ সরবরাহে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল।
দেশে অক্সিজেনের দৈনিক ঘাটতি এখন ৬৫ টন। ছয় সপ্তাহে চাহিদা বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ টন। এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিন্ডে বাংলাদেশ’ ৯০ টন সরবরাহ করছে। স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। তারপরও ঘাটতি থাকছে দৈনিক প্রায় ৬৫ টন।
লিন্ডে বাংলাদেশের লিকুইড অক্সিজেন আসে ভারত থেকে। যেহেতু ভারত তাদের সরবরাহ আপাতত বন্ধ রেখেছে, লিন্ডে বাংলাদেশ তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রেখে তা হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড, আব্দুল মোনেম লিমিটেডসহ চট্টগ্রামে লোকাল কিছু কোম্পানিও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন তৈরি করে থাকে। প্রয়োজনে তারাও হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে।
যদিও বর্তমানে হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট নেই, তবুও সামনের পরিস্থিতি যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। এজন্য সরকারি অর্থায়নে দ্রুত একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়া এখনই অক্সিজেনের বিকল্প উৎস সন্ধান করা উচিত।
চীন, সিঙ্গাপুর, রাশিয়ার কাছে অক্সিজেনের ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া যেতে পারে। করোনা চিকিৎসায় মূল উপাদানই হলো নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ। এটা উপলব্ধি করে কেন এতোদিনে আমরা সরকারিভাবে অন্তত একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণ করলাম না, এটা অবাক করা বিষয়। আগামীতে অক্সিজেন সংকট ঘনীভূত হলে এর দায়ভার কে নেবে?
ভারতে এ সময়ে অক্সিজেনের পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন ওষুধ যেমন রেমডিসিভির, টসিলিজুমাব, ডেক্সামেথাসন ইত্যাদি ওষুধের ঘাটতিও দেখা গেছে। কালোবাজারে রেমডিসিভির ৩১ হাজার রুপি দিয়ে কিনছে সাধারণ মানুষ এবং টসিলিজুমাবের ২০ হাজার রুপির একটি ডোজ অনেকেই আড়াই লক্ষ রুপি দিয়ে কিনছে। অর্থাৎ ওষুধের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি রেমডিসিভির ওষুধটি তৈরি করছে, তবুও এর প্রতিটি ডোজের দাম কিন্তু ৪,৫০০ টাকার মতো। অর্থাৎ অনেক গরিব মানুষ এটা কিনতে পারবে না। তাই সরকারি হাসপাতালে এর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে টসিলিজুমাব শুধুমাত্র একটি কোম্পানি বিদেশ থেকে নিয়ে আসে, যার দাম ডোজ অনুসারে ৮,৭০০ থেকে ৪৩,৫০০ এর মধ্যে। এজন্য ভারতের অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে এসমস্ত ওষুধের পর্যাপ্ত উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।
এছাড়া ভারতেও রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় সাধারণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও তাদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। রোগীদের এক্সরে, সিটি স্ক্যান, রক্তের নানান পরীক্ষা, করোনা টেস্ট করার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ ও সক্ষমতা আমাদের রয়েছে কি না, তা এখনোই পরিকল্পনা করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে লকডাউন কিছুটা শিথিল করে দোকানপাট, অফিসসমূহ সীমিত মাত্রায় চালু হয়েছে। ভারতীয় নতুন ধরনটি এসে থাকলে তা ব্যাপক আকারে সংক্রমণ করতেও মাসখানেক সময় লাগবে। তাই আগামী এক মাসের মধ্যে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনা করে স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের এগোতে হবে।
বর্তমানে জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে সরকার উভয় সংকটে রয়েছে। তাই, সাধারণ জনগণকে আরও নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়া, ঈদের শপিংয়ে নিরুৎসাহিত হওয়া, মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ইত্যাদির মাধ্যমে যথাসম্ভব সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। নচেৎ ভারতের মতো পরিস্থিতিতে আমাদেরকেও পড়তে হবে।
ড. মো. আব্দুল মুহিত ।। সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়