ছবি : সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ এক বিরল বৈশ্বিক কবিপ্রতিভা। আমাদের জাতীয় সংগীত বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মৃতিতে জেগে ওঠেন। এই যে এত বড় রবীন্দ্রনাথ—যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পৃথিবীর বুকে পরিচিত করে তুললেন, তাকে আমরা আজকের দিনে কতটুকু অনুভব করি বা তার সাহিত্য, গান ও অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম কতটা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে এই রকম ভাবনা উচ্চারিত হয়ে থাকে।

আমরা দেখেছি বহুজন বহুভাবে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেন কিন্তু তাকে মেনে নিতে অনেকেরই অনীহা ও অসুবিধা। রবীন্দ্রনাথ এমন এক প্রতিভা যাকে অনায়াসে অঢেলভাবে ব্যবহার করা যায় আবার মন চাইলে তাকে কারণে-অকারণে ক্ষতবিক্ষতও করা যায়। কিন্তু সত্যটা হলো বাঙালি আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বিকল্প কাউকে পায়নি। ইউটিউব ও রিল প্রজন্মের যুগে কেন আমরা রবীন্দ্রনাথকে মনে করবো কিংবা তার লেখা কবিতা, গান বা অন্য রচনার কাছে যাবো এমন চিন্তা মাথায় আসতেই পারে।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাভাষী অঞ্চলে বিপ্রতীপ ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথকে অনেকে অপাপবিদ্ধ মনুষ্যজ্ঞানে মাথায় তুলে রাখেন যার অন্য নাম অন্ধ পৌত্তলিকতা আবার অন্য এক দল আছেন যারা তাকে ছেঁটে ফেলবার জন্যে খড়্গহস্ত। বেশ আগে এই অঞ্চলের কোনো এক বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আমাদের ঐতিহ্য না। যারা এসব কথা বলেছেন তারা আজ বিস্মৃতপ্রায় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখনো একইভাবে জাগ্রত এবং দেদীপ্যমান।

নানা আক্রমণকে মোকাবিলা করেই রবীন্দ্রনাথ এখন পর্যন্ত টিকে আছেন। না, দৈহিক শক্তি দিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন তার লেখার গুণেই। পাকিস্তানি জমানায় রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানি ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে বর্জনের চেষ্টা করা হয়। মৌলবাদী গোষ্ঠী যেমন রবীন্দ্রনাথকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করেছে, পাশাপাশি বাম ও অতিবামরাও রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলে উপহাস করার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা তাদের বিপ্লবী জোশের খোরাক হতে পারেনি।

ষাটের দশকে ‘ছায়ানট’-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে পাকিস্তানি শাসকদের রবীন্দ্রবিরোধী চক্রান্ত প্রতিহত করার মানসে। বাঙালি সেইদিন রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে প্রয়োজন মনে করেছিল নিজেদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত সংগ্রামে। বাংলার যে চিরন্তন শাশ্বত রূপ, রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা তার অনবদ্য প্রতিফলন দেখি।

বাঙালির জাতীয় সংকটে রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের কবিতা-গান অবিরল প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাশে পেয়েছি, তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অদম্য সাহসে যুদ্ধে নেমেছে। 

আজকালকার দিনে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনাটি কী, কতটুকু তারা রবীন্দ্রচর্চা করে অথবা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা অনিবার্য কিনা ইত্যাকার প্রশ্ন মাঝে মাঝে শোনা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ কখনোই জনপ্রিয় কবি বা লেখক ছিলেন না। জনপ্রিয়তা জিনিসটি যে বুদবুদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ফুরিয়ে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নন।

নানা আক্রমণকে মোকাবিলা করেই রবীন্দ্রনাথ এখন পর্যন্ত টিকে আছেন। না, দৈহিক শক্তি দিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন তার লেখার গুণেই। পাকিস্তানি জমানায় রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানি ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে বর্জনের চেষ্টা করা হয়...

আমরা কেন রবীন্দ্রনাথ পড়ি? পড়ি এজন্য যে, তার লেখা পড়ে আমাদের একধরনের শান্তি লাগে, আমাদের বোধে এমন এক আলোর ইশারা তৈরি হয় যা পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক কবি ও লেখকের রচনায় পাওয়া যায়। কোনো তত্ত্ব বা দর্শনের মোহে নয়, রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে দেখতে পাই। আমাদের জীবনের এমন কোনো সুখ-দুঃখ, অনুভূতি-আবেগ বা চিন্তা নেই যা রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফুটে ওঠেনি।

মানুষ-প্রকৃতি-সভ্যতার সার্বভৌম রূপ রবীন্দ্রনাথের রচনায় এত রঙে, এত বৈচিত্র্যে, এত আন্তরিকতায় ছড়িয়ে আছে যে, মনে হয় তিনি এক অনিঃশেষ ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। গোটা বিশ ও একুশ শতকীয় সমাজ ভাবনার ক্ষেত্রে এখনো রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে—‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’

বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার কতগুলো দিক ও ক্ষেত্র রয়েছে। স্কুল-কলেজের মতো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পাঠ্য এবং একাধিক সেমিস্টারেও রবীন্দ্রনাথের নানা রচনা পাঠ্যভুক্ত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে বাংলা সাহিত্যের কোর্স রয়েছে সেই জায়গায়ও রবীন্দ্র রচনার অংশবিশেষ পাঠ্যভুক্ত। কিন্তু বিদ্যায়তনিক পরিসরে রবীন্দ্রনাথ পড়া আর রবীন্দ্রচর্চা ব্যাপারটি এক নয়।

আমাদের অঞ্চলে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্ম তারা পশ্চিমা বা ইউরোপীয়দের মতো নয়। ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার যে অবাধ বিস্তার রয়েছে, আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেই ধাঁচে গড়ে ওঠেনি। ইউরোপের যাবতীয় অগ্রগতির মূলে সেইখানকার শক্তিমান মধ্যবিত্তের জোরালো ভূমিকা স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোগাকাঙ্ক্ষার দিকে বুর্জোয়াদের মতো হলেও মনস্তত্ত্বগতভাবে তারা সামন্তঘেঁষা।

তাদের মনের গভীরে পৌরাণিক চিন্তার রেশ রয়ে গেছে বলে এই মধ্য ও উচ্চবিত্তরা সৃজনশীল সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো বা অগ্রসর সমাজ প্যাটার্ন নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে। এরা প্রচুর অর্থ দিয়ে গাড়ি-বাড়ি-মোবাইল-টেলিভিশন কেনে কিন্তু বই কেনে না, পড়ে না বা কোনো শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাও করে না।

বহুবছর আগে প্রখ্যাত অধ্যাপক কবি শঙ্খ ঘোষ ঢাকায় এক বক্তৃতায় এই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন যে, বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে রবীন্দ্রনাথ এখনো অলংকার হয়ে আছেন। অনেকে স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে রবীন্দ্রচর্চা করেন বলেও শুনেছি। শ্রদ্ধাভাজন শঙ্খ ঘোষের মন্তব্যটির মধ্যে সত্যতা থাকলেও এটা ঠিক যে, রবীন্দ্রনাথ সর্বস্তরের মানুষের কাছে পাঠ্য হয়ে উঠবেন এমনটি মনে করার কারণ নেই।

রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির অমূল্য সম্পদ। পাকিস্তানি আমলে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া ও গানের চর্চা চালিয়ে যাওয়াটাও বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম উপাদান রবীন্দ্রনাথ এবং তার গান।

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত মানুষের কাছে পাঠ্য ও চর্চার বিষয়। রবীন্দ্রনাথকে জানতে গেলে বুঝতে গেলে খানিকটা শিক্ষিত মননের দরকার পড়ে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির রুচিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আমরা অনেকেই তার ধারে কাছে নেই। এতকিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথকে আমাদের দরকার হয়। জীবনের যেকোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেই আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিই।

এমন কোনো আয়োজন বা অভিব্যক্তি নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বা কবিতার থেকে অনিবার্য কোনো চরণ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় না। গণমাধ্যম-প্রকাশনা সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে উদ্ধৃত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তিরিশের কবিরা অনেকে কবিতা লিখে যতটা পরিচিতি পাননি, তারচেয়ে বেশি নাম কুড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশেও সেই প্রবণতা চলমান। রবীন্দ্রনাথকে নিরঙ্কুশ মনে করে মাথায় তুলে রাখার কিছু নেই, কিন্তু ভিত্তিহীন অমূলক প্রসঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যখন বিদ্বেষ ছড়ানো হয় তখন বুঝতে হবে এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।

সরকারিভাবে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। এর বাইরে রবীন্দ্রস্মরণ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। আগে স্কুল-কলেজে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জন্মবার্ষিকী বেশ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হতো। আমাদের কৈশোর-তারুণ্যেও এটি পালন করেছি কিন্তু এখন এই ধরনের আয়োজন প্রায় নেই বললেই চলে। সত্যজিৎ রায়ের পর আর কেউ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বা গানকে চলচ্চিত্রে তেমনভাবে ব্যবহার করেননি।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একধরনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যে তৈরি করা হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে এই ভূখণ্ডে এক বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে রবীন্দ্রনাথ অপাঙ্‌ক্তেয়। রবীন্দ্রচর্চায় আমাদের নানামুখী সীমাবদ্ধতার মধ্যে এটিও একটি কারণ। উচ্চশিক্ষিত লোকজনের মধ্যেও রবীন্দ্রবিরাগ হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও রবীন্দ্রচর্চা থেমে নেই।

নাটকপাড়ায় রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকের একাধিক সাড়ম্বর অভিনয় হচ্ছে। দর্শকরা সেইসব দেখছেও উৎসাহের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’ প্রভৃতি নাটকের জমজমাট প্রদর্শনী অত্যন্ত ইতিবাচক। সবচেয়ে বড় কথা এসব আয়োজনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রোতা তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা।

রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির অমূল্য সম্পদ। পাকিস্তানি আমলে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া ও গানের চর্চা চালিয়ে যাওয়াটাও বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম উপাদান রবীন্দ্রনাথ এবং তার গান। প্রযুক্তিতাড়িত বর্তমান সময়ে মানুষ চটুল বিনোদনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে।

আমাদের সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে যতদিন সুকুমারবৃত্তি থাকবে, সৌন্দর্যের জন্যে আগ্রহ থাকবে, শান্তি ও কোমলতার প্রতি টান থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাশে থাকবেন। তাছাড়া বাঙালির নিজস্ব পরিচয় টিকিয়ে রাখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ প্রদীপ্ত সূর্যের মতোই আমাদের আলো দেবেন।

ড. চঞ্চল কুমার বোস ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়