ছবি : সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই মুহূর্তে প্রিয় আর আলোচিত সিনেমার নাম লাপাতা লেডিস (Laapataa Ladies, 2023)। সিনেমাহলে মুক্তির পর যতটা না আলোচনায় এসেছে নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর তুলনামূলক বেশি আলোচনায় এসেছে আর তা স্বভাবতই বুঝিয়ে দিচ্ছে ওটিটির প্রতি মানুষের নির্ভরতা দিনদিন কতটা বাড়ছে।

সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য, পুরুষতন্ত্র, যৌতুকপ্রথা, কঠিন পর্দাপ্রথা নিয়ে বিশাল সাইজের বই আর বড় বড় সভা সেমিনারে যেসব গুরুগম্ভীর আলাপ করা হয়, সেইসব আলাপ কিরণ রাও (Kiran Rao) তার নতুন সিনেমা লাপাতা লেডিসে করেছেন সহজভাবে, কৌতুক আবহে।

গ্রামের গল্প এই সিনেমায় এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাতে গ্রামের মানুষ তো অবশ্যই; শহরে বড় বড় বুলি আওড়ানো মানুষও খুব সহজেই এই সিনেমার সাথে কানেক্ট হতে পারবেন। বেশ সাদামাটা এক গল্প নিয়েই এগিয়েছে লাপাতা লেডিস।

দীপক নামের গ্রামের এক সাধারণ ছেলে অন্য এক গ্রাম থেকে ফুল নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিজের গ্রামে নিয়ে আসে। বিয়ের এই আনন্দ উৎসবে পুরো এলাকা যখন উচ্ছ্বসিত, তখনই ঘোমটা তুলতে দেখা যায়—এ তো ফুল নয়, অন্য কেউ! যে ট্রেনে চেপে বউ এনেছে দীপক, সেই ট্রেনেই বউ বদলে গিয়েছে ভুলবশত! বউ ভেবে যাকে এতদূর সঙ্গে করে নিয়ে এলো, সে আসলে অন্য কারও বউ!

এবার শুরু হয় বউ খোঁজার পালা। কিন্তু ঘোমটায় ঢাকা বউয়ের ছবি দেখে পুলিশ বা এলাকার লোকজন-কারও পক্ষেই বউকে খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না।

অন্যদিকে ফুল স্টেশন থেকে নেমে নিজের বরকে খুঁজে পায় না। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে সংসারের প্রায় সব কাজ শেখা হলেও, কীভাবে পথ চিনে বাড়ি ফিরতে হয়, কীভাবে নিজের বরের নাম উচ্চারণ করতে হয়—তা আর ফুলের শেখা হয়নি। স্টেশনে দোকানদার মঞ্জু মাইয়ের সঙ্গে ফুলের পরিচয় হয়। শুরুতে ফুলের স্বামীর প্রতি অন্ধ ভালোবাসা দেখে মঞ্জু মাই খানিকটা রাগ করলেও, ক্রমশ ফুলকে আপন করে নেন তিনি।

পোস্ট কোভিড বলিউড মানেই যেখানে মারদাঙ্গা সিনেমা বা এজেন্ডার সিনেমা, সেই জায়গায় লাপাতা লেডিসের মতো এজেন্ডাহীন সিনেমা যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো।

এদিকে বউ বদলের জেরে দীপকের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেওয়া পুষ্পা বা জয়াকে ঘিরে জমে ওঠে রহস্যের দানা। থানার দারোগা ও দর্শক সবার সন্দেহ এক বিন্দুতে এসে মিলে—এই মেয়ে নির্ঘাত ডাকাত দলের সদস্য, বিয়ে করে দামি গয়না নিয়ে চম্পট দেওয়াই তার কাজ। এই রকম নানা ঘটনার ঘনঘটায় এগিয়ে যায় সিনেমা।

লাপাতা লেডিস এত মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া আর পছন্দ হওয়ার সবচেয়ে প্রধান কারণ সম্ভবত এর গল্প বলার সরলতা। পোস্ট কোভিড বলিউড মানেই যেখানে মারদাঙ্গা সিনেমা বা এজেন্ডার সিনেমা, সেই জায়গায় লাপাতা লেডিসের মতো এজেন্ডাহীন সিনেমা যেন এক পশলা বৃষ্টির মতো।

এজন্য শুরুতেই ধন্যবাদ দিতে হয় বিপ্লব গোস্বামীকে এমন গল্পের জন্য; বিশেষ ধন্যবাদ স্নেহা দেশাই আর দিব্যনিধি শর্মাকে যাদের জন্য বিপ্লবের ডার্ক টোনের স্ক্রিনপ্লেতে এসেছে স্যাটায়ারের ছোঁয়া। আর দিনশেষে স্যাটায়ারের মোড়কে সামাজিক বার্তা দর্শকের মনোগ্রাহী করে উপস্থাপনের কৃতিত্ব কিরণ রাওকে।

ধোবি ঘাট (Dhobi Ghat, 2010)-এর ১৩ বছর পর ডিরেকশনে ফিরে এসে তিনি দর্শকের কাছ থেকে একটি কথায় শুনবেন—কেন আরও নিয়মিত সিনেমা বানান না কিরণ রাও?

এই একই গল্প বাংলাদেশে হতে গেলে শুরুতেই হয়তো অনেকেই বাতিল ঘোষণা করতো। গিমিকের গল্প, শেষে গিয়ে একটা বড়সড় টুইস্টের গল্প, বিশাল ক্যানভাসের বিভিন্ন বাহিনীর গল্প, মার্ডার মিস্ট্রির গল্প বলতে বলতে আমরা সম্ভবত সহজসরল গল্প বলাই ভুলে গেছি বা সহজসরল গল্পে বিশ্বাস রাখতেও ভুলে গেছি। তাই হয়তো দর্শকও নির্মাতাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন।

লাপাতা লেডিসের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ তুলনামূলক কম পরিচিত বা একেবারেই নতুন অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করানো। রবি কিষাণ বাদে সেইভাবে আর কেউই দর্শকের পরিচিত মুখ নন; তাই তাদের যেকোনো অভিব্যক্তি দর্শকের কাছে নতুন আর আমোদিত করার জন্য যথেষ্ট।

আমির খান চেষ্টা করেছিলেন রবি কিষাণের চরিত্রটি করার জন্য, কিন্তু কিরন রাও স্টারের ভার নিয়ে সিনেমা করতে চাননি বলেই দিনশেষে রবি কিষাণের সুযোগ হয়েছে আর তাতে সিনেমাটি আরও বেশি রিয়েলিস্টিক লেগেছে।

একই ব্যাপারটা বাংলাদেশে হলে কেমন হতো?

এমন গল্প সিনেমাহলে না হলেও যেকোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে গেলে সেইখানে হয়তো 'অভিনেতা' নেওয়ার চেয়ে 'স্টার' নেওয়ার জন্য জোর দেওয়া হতো। তাতে হয়তো অনেক মানুষের কাছে গল্পটা পৌঁছাতে পারতো তবে দিনশেষে গল্পের সারল্যটা নষ্ট হয়ে যেতো। আবার সবকিছু ঠিকঠাক হলেও দেখা যাবে দর্শক দিনশেষে সিনেমাটা দেখতেন না কারণ এটা কোনো 'ভাইরাল' কনটেন্ট নয় বা এর সাথে তার প্রিয় কোনো তারকার নাম জড়িয়ে নেই।

লাপাতা লেডিসের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, নিজের বউয়ের ছবি নিয়ে বাজারে খুঁজতে বের হয় দীপক। এক দোকানদারকে ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ছবি দেখে বলেন, 'ছবিতে তো বউয়ের চেহারাই দেখা যাচ্ছে না। একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় জানা যায় তার চেহারার মাধ্যমে, সেই চেহারাই দেখা না গেলে আর বাকি রইলো কী?'

বাক্য শেষ হতে না হতেই সেই 'মুসলিম' দোকানদারকে চা দিতে আসেন তার স্ত্রী, যার কিনা নেকাব দিয়ে চোখ ঢাকা, চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

একই দৃশ্য বা সংলাপ বাংলাদেশের কোনো সিনেমায় হয়তো কল্পনাই করা যেত না। বাংলাদেশের কোনো লেখক হয়তো এই দৃশ্য ভাবতে পারবেন, তবে এই দৃশ্য সিনেমায় রাখলে একটি বিশেষ অংশের দর্শকের 'অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত' হবে কিনা, তারা রেগে যাবে কিনা, সিনেমাকে বয়কট ঘোষণা করবে কিনা—এইসব ভেবে সিনেমার ডিরেক্টর ইতিমধ্যেই এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপে চলে যাবেন।

এরপরেও যদি কোনো ডিরেক্টর সাহস করে এই ধরনের দৃশ্য রাখেন, দিনশেষে 'মহান সেন্সরবোর্ড' সেই দৃশ্যে কাঁচি চালাতে দ্বিধাবোধ করবেন না। আরও বাজে অবস্থা হলে হয়তো সিনেমাকেও আটকে দিতে পারে সেন্সরবোর্ড।

...এই রকম একটা গল্প লেখার জন্য বা ভাবার জন্য যে পরিমাণ সময় দরকার, তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখকদের দেওয়া হবে না। কোনো কারণে দেওয়া হলেও তার ক্রেডিট বা তার প্রাপ্য টাকা দেওয়া হবে না। তাহলে ভালো সিনেমা হবে কীভাবে?

নিজের প্রথম সিনেমা তৈরির পর ১৩ বছর সময় নিয়েছেন ডিরেক্টর কিরণ রাও লাপাতা লেডিসের জন্য। Good things take time—এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রোডিউসার আর ডিরেক্টর বুঝতে চান না। তারা বেশিরভাগই ‘ধর তক্তা মার পেরেক’-এ বিশ্বাসী।

দ্রুত প্রোডাকশন ডেলিভারি দিয়েই আরেকটা 'প্রোজেক্ট' ধরায় যেখানে বেশিরভাগের উদ্দেশ্য; সময় নেওয়া, আশেপাশের মানুষদের দেখা, পড়া, বোঝার যেখানে বালাই নেই—সেই জায়গায় লাপাতা লেডিস তৈরি হবে এটা আশা করাও অনেকটা দুরাশা। এই রকম একটা গল্প লেখার জন্য বা ভাবার জন্য যে পরিমাণ সময় দরকার, তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখকদের দেওয়া হবে না। কোনো কারণে দেওয়া হলেও তার ক্রেডিট বা তার প্রাপ্য টাকা দেওয়া হবে না। তাহলে ভালো সিনেমা হবে কীভাবে?

এজন্যই লাপাতা লেডিসের মতো সিনেমা দেখলে আমাদের আফসোস আরও বাড়ে। কেন এই ধরনের সিনেমা হয় না, কেন আমরা বানাতে পারি না, কীসের আমাদের এত অভাব—এই রকম নানা প্রশ্ন ভিড় করে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি উপরে, আরও বিস্তারিত উত্তর দিতে গেলে লেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে মূল কারণ হবে সদিচ্ছার অভাব আর প্রতিটা জায়গায় অসততার কথায় উঠে আসবে।

আমাদের মাঝে অধিকাংশের লাপাতা লেডিস দেখার একটি কারণ কিন্তু অবশ্যই এটা আমির খান প্রোডাকশনের সিনেমা। লগান (Lagaan, 2001) সিনেমার মাধ্যমে এই প্রোডাকশন হাউজের যাত্রা শুরু হয়। দিনের পর দিন একেবারেই অন্যরকম গল্পের কন্টেন্ট, বক্স অফিস আর ক্রিটিক্স দুই জায়গায় সাধুবাদ অর্জনের জন্যই সম্ভবত আজ আমির খান এই ধরনের প্রোজেক্টে বিশ্বাস করে ইনেভস্ট করতে পারেন সম্পূর্ণ নবাগতদের নিয়ে।

২০০১ সাল হলে তিনিও হয়তো পারতেন না। ২০২৪ বলেই হয়তো সম্ভব হয়েছে, সামনে আরও হবে। আমির খানের মতো এই রকম একজন বিজ্ঞ প্রোডিউসারের অভাবও রয়েছে আমাদের। যিনি কিনা আক্ষরিক অর্থেই প্রোডিউসার, ইনভেস্টর না শুধু কাগজে কলমে।

দিনশেষে একটি ভালো সিনেমা বা কনটেন্টের দায় সবার। ভালো সিনেমা শুধু বানালেই হয় না, তা অ্যাপ্রিসিয়েট করার মতো প্ল্যাটফর্ম আর দর্শকও থাকা লাগে, তা না হলে আগ্রহটা মরে যায়। আবার ভালো সিনেমা দেখার জন্য আকুল হয়ে থাকা দর্শকের আগ্রহটাও টের পেতে হয়, শুধুমাত্র সিংহভাগ দর্শক যা 'খাচ্ছে' তার পেছনে দৌড়ালেই হয় না।

সিনেমার নাম লাপাতা লেডিস হলেও সিনেমার শেষে কেউ আর লাপাতা বা নিখোঁজ থাকে না, সবাই সবার গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ফুল খুঁজে পায় দীপককে, জয়া যাত্রা করে নিজের গন্তব্যে। বাংলাদেশের নির্মাতা আর দর্শকেরা যার যার গন্তব্য কবে খুঁজে পাবে, আপাতত সেই দিনের অপেক্ষায়।

সৈয়দ নাজমুস সাকিব ।। শিক্ষক