ছবি : সংগৃহীত

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই তথ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। প্রযুক্তির এই কল্যাণে E-Business, E-Commerce, E-Marketing, E- Banking ইত্যাদি পরিভাষার সাথে প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছে অর্থনীতি। এমনই একটি পরিভাষা হলো মোবাইল ব্যাংকিং (Mobile Banking) যা আধুনিক ব্যাংকিংয়ের নতুন সংযোজন।

মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বলা হয় মোবাইল ব্যাংকিং। প্রযুক্তিপ্রেমী সমাজকে সেকেলে ও কাগুজে ব্যাংকিং কার্যক্রমের পরিবর্তে অত্যাধুনিক ও বিদ্যুৎগতির ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করছে মোবাইল ব্যাংকিং।

১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে আসে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো। সীমাবদ্ধ সুবিধা সম্পন্ন এই সেবাটি তখন এসএমএস ব্যাংকিং নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ২০১০ সালে অ্যাপলের আইফোন ও অ্যান্ড্র্রয়েড ভিত্তিক স্মার্টফোনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) নির্মাণের মাধ্যমে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার দুনিয়ায় আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সময়ের স্রোতে প্রযুক্তির হাত ধরে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মান ও পরিধি। ডিজিটাল লাইফস্টাইলে যুক্ত করেছে নতুনমাত্রা।

সময় অসময় বলে কোনো কথা নেই। মুহূর্তেই লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কোনো জুড়ি নেই। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ২০১১ সালে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, সিউর ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায় ইত্যাদি বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতে খুবই পরিচিত নাম।

ঘরে বসেই ঝামেলামুক্তভাবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠানে খোলা যাচ্ছে হিসাব। ফলস্বরূপ দিন দিন বেড়ে চলেছে গ্রাহকের সংখ্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমএফএস হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ২২ কোটি ১৪ লাখ ৭৮ হাজার। অনেক গ্রাহক খুলেছেন একাধিক হিসাব।

গ্রাহক সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের পরিমাণ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। যা ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ছিল মাত্র ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন অবদান রাখছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। বাড়ছে মাথাপিছু আয়।

১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে আসে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো। সীমাবদ্ধ সুবিধা সম্পন্ন এই সেবাটি তখন এসএমএস ব্যাংকিং নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ২০১০ সালে অ্যাপলের আইফোন ও অ্যান্ড্র্রয়েড ভিত্তিক স্মার্টফোনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) নির্মাণের মাধ্যমে, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার দুনিয়ায় আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর সহজে, দ্রুততম সময়ে এবং নিরাপদে আর্থিক সেবা পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে রাতারাতি বাড়তে থাকে এমএফএস-এর গুরুত্ব ও গ্রাহক সংখ্যা। ২০১৯ সালে এমএফএস গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৪৩ লাখ যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী পরবর্তী চার বছরে ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যক্তিগত লেনদেনেও মোবাইল নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাতে থাকা মোবাইলটি মানুষের নগদ অর্থের চাহিদা পূরণ করছে। ব্যাংকে না গিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন বিল (বিদ্যুৎ, ওয়াসা, গ্যাস, টেলিফোন) পরিশোধ করা যাচ্ছে এক নিমিষেই। এতে লাঘব হয়েছে মানুষের সময় ও শ্রম ব্যয়।

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন, সুপার শপ ও অনলাইনে কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, পেনশন, বাস, ট্রেন ও প্লেনের টিকিট ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন অনুদান ও সাহায্য প্রদান, রেমিট্যান্স পাঠানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম।

একযুগ পাড়ি দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এমএফএসগুলোর মাধ্যমে প্রতিমাসে এক ট্রিলিয়ন টাকা লেনদেন হচ্ছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল যেখানে ৭ ট্রিলিয়ন টাকার বেশি। সেইখানে প্রতিবছরে শুধুমাত্র এমএফএসগুলোর মাধ্যমে বাজেটের চেয়ে বেশি লেনদেন হচ্ছে।

২০১০ সালের আগে এই পরিস্থিতি চিন্তাও করা যেত না। সেই সময় কাউকে টাকা পাঠানোর জন্য সরাসরি যেতে হতো বা ডাক বিভাগের মানি অর্ডার ও কুরিয়ার সার্ভিসের সাহায্য নিতে। আর এখন হাতের মুঠোর মোবাইল দিয়ে এক ক্লিকেই টাকা পাঠানো যাচ্ছে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

২০২১ সালে প্রকাশিত সরকারের জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশলপত্রে ২০২৬ সালের মধ্যে শতভাগ জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এমএফএস। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে অর্থনীতির মূলধারায় সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিং অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনজীবনে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রামের আত্মীয়স্বজনের কাছে সরাসরি পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, শহরের ৩১.২৬ শতাংশ এবং গ্রামের ২২.৫১ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। যেখানে ২০১১ সালে প্রাপ্তবয়স্ক ৩২ শতাংশ মানুষ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় ছিল।

মোবাইল ব্যাংকিং অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে গ্রামীণ জনজীবনে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রামের আত্মীয়স্বজনের কাছে সরাসরি পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং ভূমিকা রাখছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাপ্ত টাকার সিংহভাগই গ্রামের মানুষ খরচ করে থাকে ভোগে। তাই বলা যায়, গরিবের ভোগ বৃদ্ধি তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক অবদান রাখছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা।

পিছিয়ে পড়া নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস। চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ সামলানো নারী সবাই যুক্ত হতে পারছেন এমএফএস খাতে।

এমএফএস হিসাব খোলার দিক গ্রামীণ নারীরা শহুরে নারীর চেয়ে এগিয়ে আছে। নারীদের বড় অংশ বাড়িতে বসে শহর থেকে পাঠানো অর্থ হাতে পাচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ৫২.৩৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৬.৫৭ শতাংশ নারী মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছেন।

মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস এজেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এজেন্টরা সরাসরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করতে পারছে।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পমালিক থেকে শুরু করে অল্প আয়ের মানুষ, সবাই পাচ্ছে এমএফএস-এর সুবিধা। ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিক্রির টাকা এই সেবার মাধ্যমে সংগ্রহ করছে। শ্রমিকের বেতন দেওয়া, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ ও আদায় এবং বিদেশি সংস্থার তহবিল বিতরণও হচ্ছে এর মাধ্যমে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সিংহভাগই বিকাশের দখলে। মোবাইল ব্যাংকিং বাজারে একচেটিয়া মনোভাব ভেঙে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই খাতের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করা সম্ভব। সাথে প্রয়োজন এমএফএস-এর মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবন যাত্রার মানের উপর মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ধনাত্মক ভূমিকা দৃশ্যমান। স্মার্ট বাংলাদেশে ফিনান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করে ক্যাশলেস সমাজ বিনির্মাণে মোবাইল ব্যাংকিং হয়ে উঠেছে প্রধান হাতিয়ার।

দীপিকা মজুমদার ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়