ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লড়াই যখন চলমান
একটি যথার্থ পদক্ষেপ সূচনায় ছোট থাকলেও ইতিহাস যে তাকে একসময় জাতির চিরায়ত ঐতিহ্যের অনিবার্য অংশে পরিণত করতে পারে তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলা। চট্টগ্রামের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি আবদুল জব্বার সওদাগর এই বলীখেলার সূচনা করেন ১৯০৯ সালে, গোটা ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে।
বলীখেলা হচ্ছে কুস্তি বা রেসলিং প্রতিযোগিতারই একটা ফর্ম। এমনিতে চট্টগ্রাম এলাকায় বলীখেলা বেশ লোকপ্রিয় একটি খেলা। জব্বারের বলীখেলাটি প্রতিবছর বৈশাখের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম শহরের লালদিঘী মাঠে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আরও অনেক জায়গায় বছরে একবার এইরকম একটা বলীখেলা হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রতিটি বলীখেলাকে ঘিরেই মেলার মতো হয়, প্রচুর লোকসমাগম হয়। এইরকম সব খেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে জব্বারের বলীখেলা। এর একটা কারণ হতে পারে যে এই প্রতিযোগিতার সূচনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, যার শুরু থেকেই এলাকার মানুষ নিজেদের সম্পৃক্ত ভাবতে পেরেছে।
আরও পড়ুন
ভারতবর্ষে ইংরেজ বণিকরা অনেক আগে থেকে থাকলেও বাংলা দখল করাটাই ছিল শাসক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পথে ওদের প্রথম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করে নেয় সেইকথা আমরা সবাই জানি। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন সেইসময় মুঘলদের অধীনে বাংলার শাসক-নবাব।
১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি ইংরেজ কোম্পানি হয়ে যায় মুঘল রাজার অধীনে বাংলার শাসক। এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতের আরও নানা অঞ্চল দখল করে নিয়ে শক্তিশালী শাসকে পরিণত হয়।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার অধীনে চলে আসে ভারতের শাসন আর সেই থেকে বাংলা হয়ে পড়ে ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ। সেই ১৭৫৭ থেকে শুরু করে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের রাজধানী ছিল বাংলার-কলকাতায়।
কলকাতায় অনুশীলন সমিতি গঠিত হয় ১৯০২ সালে। অনুশীলন সমিতি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো একেকটা শরীরচর্চা কেন্দ্র বা ব্যায়ামাগারকে কেন্দ্র করে। অনুশীলন আন্দোলনের সূচনা কলকাতা থেকে শুরু হলেও ১৯০৫ সালের পর থেকে ঢাকায় অনুশীলন সমিতির কার্যক্রম কলকাতার চেয়ে বিস্তৃত ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বিংশ শতকের শুরুতেই অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। কলকাতায় অনুশীলন সমিতি গঠিত হয় ১৯০২ সালে। অনুশীলন সমিতি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো একেকটা শরীরচর্চা কেন্দ্র বা ব্যায়ামাগারকে কেন্দ্র করে। অনুশীলন আন্দোলনের সূচনা কলকাতা থেকে শুরু হলেও ১৯০৫ সালের পর থেকে ঢাকায় অনুশীলন সমিতির কার্যক্রম কলকাতার চেয়ে বিস্তৃত ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ঢাকার পর ময়মনসিংহেও অনুশীলন সমিতির আরেকটি শাখা বেশ বড় ও প্রভাবশালী ছিল। অনুশীলন সমিতির একটা সীমাবদ্ধতা ছিল যে, এই সংগঠনের সদস্যরা প্রায় সকলেই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী যুবক, মুসলিম যুবকরা ওদের সাথে খুব একটা সংশ্লিষ্ট হতো না। চট্টগ্রামে অনুশীলন সমিতির কার্যক্রম ছিল বটে, কিন্তু চট্টগ্রামে বিপ্লবীরা অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত না হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। মাস্টারদা সূর্যসেন ও তার সহকর্মীরা যেমন গঠন করেছিলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি।
আরও পড়ুন
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠিত হওয়ারও আগে ১৮৯২ সালে ও ১৯০১ সালে চট্টগ্রামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ সরকার যখন আসামের সাথে জুড়ে দিতে চেষ্টা করে সেই প্রতিরোধের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছিল। এর একটা ছিল ১৮৯৫-৯৬ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলন আর ১৯০২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন নামে একটা রাজনৈতিক সংগঠনের আবির্ভাব।
অন্যভাবে বললে, অবিভক্ত বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকলেও চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একাধিক স্বতন্ত্র ধারাও বিরাজ করছিল সেই সময়। এইসব ধারার মধ্যে যেমন নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল, তেমনি সশস্ত্র আন্দোলনের ধারাও ছিল এমনকি প্রায় সুসংগঠিত সামরিক কার্যক্রমও ছিল। মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তার সহকর্মীরা যেমন একটি সুসংগঠিত সামরিক সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছিলেন।
আবদুল জব্বার সওদাগর যখন নিজের খরচে এবং নিজের ব্যবস্থাপনায় বলীখেলার প্রবর্তন করেন তখন এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল যে চট্টগ্রামের যুবসমাজ যেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। বিশেষভাবে তার লক্ষ্য ছিল মুসলিম যুবসমাজের প্রতি—কেননা তখন অনুশীলন সমিতি বা যুগান্তরের সাথে বা অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে চট্টগ্রামের মুসলিম যুবকদের সেই রকম সংশ্রব ছিল না।
আবদুল জব্বার সওদাগরের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে এই বলীখেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের মুসলিম যুবসমাজ নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে আবদুল জব্বারের এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা এমনিতে চট্টগ্রামে মুখে মুখে সবাই জানেন বটে কিন্তু এর প্রামাণ্য দলিলপত্রাদি নেই।
আবদুল জব্বার সওদাগর যখন নিজের খরচে এবং নিজের ব্যবস্থাপনায় বলীখেলার প্রবর্তন করেন তখন এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল যে চট্টগ্রামের যুবসমাজ যেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে।
থাকার কথাও না কেননা আবদুল জব্বারের মনে সেই রকম ইচ্ছা থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই তিনি তো নিশ্চয়ই আনুষ্ঠানিকভাবে কোথাও সিদ্ধান্ত আকারে তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তবে তার ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায় একটা ঘটনা থেকে। ১৯১১ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার সওদাগরকে খান বাহাদুর উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব করে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রথমদিকে ছোট আকারে শুরু হলেও ধীরে ধীরে জব্বারের বলীখেলা কেবল চট্টগ্রাম শহরের একটা ক্রীড়া অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত আকার ছেড়ে আঞ্চলিক বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়। দূরদূরান্ত থেকে বলী বা কুস্তিগিররা এসে যোগ দিতে থাকেন এই প্রতিযোগিতায়। এখানে জয় লাভ করা একদম জাতীয়ভাবেই একটা সম্মানজনক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন
২০২৪ সালের বলীখেলায় সারা দেশ থেকে ৮৬ জন বলী অংশ নেন। বলীদের আগমন আর মূল প্রতিযোগিতাকে ছাড়িয়ে বলীখেলার তিনদিন আর তার আগের পরের কয়েকদিন মিলিয়ে লালদীঘির ময়দান এবং ময়দান ছাড়িয়ে গোটা চট্টগ্রামে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। একটা মেলা হয়, সেই মেলা এবং মেলাকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের আগমন এই সবকিছু মিলিয়ে মোটামুটি সপ্তাহখানেক অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করে চট্টগ্রাম শহরে। জাতীয়ভাবে সব গণমাধ্যম এই বলীখেলা ও মেলার খবরাখবর বিস্তারিত সম্প্রচার করে। সারা দেশের চোখ থাকে এই উৎসবের দিকে।
অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত ছোট একটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কালের বিবর্তনে এইরকম বিশাল জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। জব্বারের বলীখেলা, যেটা শুরু হয়েছিল একজন মুসলমান বণিকের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে, যেন ওর সম্প্রদায়ের যুবকেরা দেশে মুক্তির জন্য ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে, তা এখন সব অর্থেই একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এই উৎসব একসময় পারিবারিকভাবে পরিচালিত হলেও এখন তা সামাজিক ও সরকারি যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। একটু সচেতনভাবে সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত করা গেলে একসময় এই উৎসবটি হয়ে উঠতে পারে সারা উপমহাদেশের জন্যে স্বাধীনতা ও সংগ্রামের চেতনার প্রতীক হিসেবে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট