মে দিবস এবং শ্রমিকের লড়াই
আজ আমাদের টুটি টিপে ধরেছো।
কিন্তু আমাদের নীরবতা সেই কণ্ঠস্বরের চেয়েও অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
বিজ্ঞাপন
এমন দিন আসবে!
[মে আন্দোলনের শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পাইজারের ফাঁসির মঞ্চের বক্তব্য]
১৮৮৬ সালে মে দিবসের সূত্রপাত। এত বছরে আমাদের দেশের মেহনতি জনগণ এই দিবসের সুফল কতটা পেয়েছে তার হিসাব করা জরুরি। যদিও জটিল হিসাবে না গিয়ে সরল রেখাই বলা যায়, আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার অধিকার পায়নি। যে মজুরি তাতে ৮ ঘণ্টা কাগজে কলমে থাকলেও বাঁচার জন্যই বাড়তি কাজ করতেই হয়।
আইনে ওভারটাইম ধারায় বাড়তি ৪ ঘণ্টার কাজের কথা আছে। আইনি সময়ের বাইরে নানা অজুহাতে শ্রমিকদের ফাও খাটানো বা বিনা মজুরিতে কাজ করাতে বাধ্য করে মালিকপক্ষ পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য খাতে। মাত্রাতিরিক্ত বাড়তি কাজ, ওভারটাইম, তারুণ্যর সব শক্তি কারখানার চার দেয়ালে, মেশিনের চাকায় বা অর্থনীতির উন্নয়নে নিঃশেষ করা ছাড়া তাদের বাঁচার অধিকার যেন নেই।
আরও পড়ুন
মর্যাদাপূর্ণ বাঁচাতো দূরের কথা, ৮ ঘণ্টা কাজে যে মজুরি তাতে খেয়ে পড়ে বাঁচাই কঠিন। কিন্তু স্বাস্থ্য ও উৎপাদন রক্ষায় বিশ্রাম আবশ্যিক শর্ত তা সবার জানা। অথচ শ্রমিকের জন্য এই ধ্রুব সত্য, যেন সত্য নয়। শ্রমিকের শব্দ ভান্ডারে বিশ্রামের যেন জায়গা নেই। বিশ্রাম-বিনোদন বা কেবল ৮ ঘণ্টা কাজে বাঁচার সাধ যেন বিলাসিতা মাত্র। বাড়িয়ে বলার সুযোগ নেই।
তারুণ্য ক্ষয় করা যেন এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় মেহনতির পরিণতি হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে। মালিক-সরকার-বায়ারের পোশাক শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সেই বাস্তবতাকেই প্রতিধ্বনিত করে। আর এইসব নিয়ে কথা বললে কাজ হারানোর ভয়, জেল-জুলুম এমনকি প্রাণ যাওয়ার ভয়ও তাড়া করে প্রতিনিয়ত। আর যখন দেশে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার হুমকির মুখে থাকে শ্রমজীবীরা সবচেয়ে দুর্দশায় পড়ে তা বুঝতে খুব হিসাব করার দরকার হয় না। একটা দমবন্ধ গুমোট এবং ভয় ও লোভের চাদর মুড়ে আছে শ্রমিক এলাকা—শ্রমিক আন্দোলন এবং পুরো দেশ।
সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ৮ হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে ১২ হাজার হয়েছে। যেখানে শ্রমিকদের দাবি ছিল ২৫ হাজার টাকা মজুরি। কেউ কেউ অবশ্য ২৩ হাজারও দাবি তুলেছিলেন। অথচ তাদের আকাঙ্ক্ষার ধারেকাছে পৌঁছায়নি নির্ধারিত মজুরি। নতুন মজুরি নতুন আকারে মাত্রাতিরিক্ত কাজ-ক্লান্তি ও শোষণের বোঝা নিয়ে চেপে আছে শ্রমিকের ওপর। তরুণ পোশাক শ্রমিকদের ক্লান্ত চোখ, ম্লান চেহারা, ফ্যাকাসে ত্বকই তার দৃষ্টান্ত। সূর্যোদয় থেকে রাত অব্দি কাজ তার ওপর গরমে নির্ঘুম রাত। সব মিলিয়ে বেসামাল শ্রমিকের জীবন।
...শ্রমিকের শব্দ ভান্ডারে বিশ্রামের যেন জায়গা নেই। বিশ্রাম-বিনোদন বা কেবল ৮ ঘণ্টা কাজে বাঁচার সাধ যেন বিলাসিতা মাত্র। বাড়িয়ে বলার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। তার ওপর বাড়তি কাজের বোঝা। ৮ ঘণ্টার আন্দোলন কেবল কাগজে, ৮ ঘণ্টার স্বীকৃতিতেই আটকে রাখলে শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যেই আমরা আটকে থাকবো। ৮ ঘণ্টা কাজে যাতে শ্রমিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং মজুরি পায় সেই প্রশ্ন শ্রমিক আন্দোলনের সামনে আনার সময় এসেছে। ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কাজ না করেই যাতে একজন ৮ ঘণ্টায় মর্যাদাপূর্ণ মজুরি জীবন পায় সেই দাবি এখন জরুরি।
সন্দেহ নেই শ্রমিকের নানা সংকট ও দুর্দশার মধ্যেও নতুন করে লড়াই সজ্জিত করার অনুপ্রেরণা দেয় মে দিবস। ফাঁসির মঞ্চে ক্ষমা ভিক্ষা না করে মে দিবসের আন্দোলনের শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পাইজারের বক্তব্য যেন বর্তমানে রাজনৈতিক আবহাওয়ায় নতুন করে ভাবায়-অনুপ্রেরণা জোগায়।
মে দিবসের সাহসী লড়াকুদের মধ্যে আগস্ট স্পাইজার ছিলেন ৪ জনের ১ জন। ১৮৮৬ সালের আন্দোলনের ১ বছরের মাথায় ১৮৮৭ সালে ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে আগস্ট সাহস ছড়িয়ে গেছেন সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ে।
আরও পড়ুন
৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদন স্লোগানে মুখরিত ছিল উনিশ শতকের আমেরিকা-ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলন। উনিশ শতকের শেষভাগ ছিল আন্দোলনে সরব সময়। ধর্মঘট-সমাবেশ-মিছিল-কাজ বন্ধ করা ছিল নিয়মিত ঘটনা। স্বর্গ সুখের—আশায় আশেপাশের দেশ থেকেও শ্রমিকরা আমেরিকায় আসতো।
সরকারি হিসাব মতে, ওই সময় অর্থাৎ ১৮৮০ সাল থেকে ১০ বছরে ৫২,৪৬,৬১৩ জন আমেরিকায় এসেছিল কাজের সন্ধানে এবং ভালো থাকার আশায়। কেউ রুটি কারখানা, কেউ ইস্পাতের চুল্লিতে, রেল শ্রমিক তৈরি করেছে রেলগাড়ি, কেউ হয়েছে ম্যাকানিক, কেউবা সুড়ঙ্গ কেটে পথ বানানোর কাজে ব্যস্ত, এমনকি কেউ হয়েছে পোশাক শ্রমিক এমনই নানা শ্রমিক।
তখন কাজের সময় নির্দিষ্ট ছিল না। ১৪ ঘণ্টা, ১৬ ঘণ্টা, কখনো ১৮ ঘণ্টা বা আরও বেশি সময় কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। এর এদিক ওদিক হলেই নেমে আসতো নির্যাতন। প্রাণ ভরে খোলা আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নেওয়া; দিনের আলো ঠিকমতো দেখা বা গায়ে মাখার সুযোগ তাদের হয়নি বললেই চলে।
উল্টো ১ মে ৩ লক্ষাধিক শ্রমিকের সমাবেশ ও ধর্মঘট এবং ৩ ও ৪ মের আট ঘণ্টার জন্য আন্দোলন করার অপরাধে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেট স্কয়ারের চত্বরে শ্রমিকদের উপর লাঠিচার্জ এবং গুলি চলে। হতাহত হয়ে, গুলি খেয়ে এবং ফাঁসিতে ঝুলে প্রাণ হারায় শ্রমিকরা।
দেশে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার হুমকির মুখে থাকে শ্রমজীবীরা সবচেয়ে দুর্দশায় পড়ে তা বুঝতে খুব হিসাব করার দরকার হয় না। একটা দমবন্ধ গুমোট এবং ভয় ও লোভের চাদর মুড়ে আছে শ্রমিক এলাকা—শ্রমিক আন্দোলন এবং পুরো দেশ।
সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় নয়, ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা চাই—স্লোগান উঠেছিল তখন চারদিকে। মে দিবসের কয়েক বছর আগে থেকেই আইজাক. জি ব্ল্যাংকার্ডের কথায় এবং রেভ জেসের সুরে ‘দিনে আট ঘণ্টা’ নামে একটি গান শ্রমিক আন্দোলনে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ব্ল্যাংকার্ড এবং জোনস দুইজনই আমেরিকার বোস্টনের অধিবাসী ছিলেন। শ্রমিকের দুঃসহ জীবন আর প্রকৃতির টানে মিশেল শব্দে শক্তিশালী এই গানটি আন্দোলনকে নতুন ভাষা দেয়। এটি পরিণত হয় আন্দোলনের অংশে ও শক্তিতে। এই গান যখন শ্রমিকের যন্ত্রের মতো জীবন এবং প্রাণ নিঃশেষের গল্প বলছে সুরে সুরে তখন শ্রমঘণ্টা কমানোর দাবিতে চারদিক মুখরিত।
আরও পড়ুন
আমেরিকা-ইউরোপসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট ও বিরাট সমাবেশ হচ্ছে আট ঘণ্টার দাবিকে প্রধান করে। এই গানটি বলে দেয় কীভাবে ওই সময়ে শ্রমিকরা তাদের তারুণ্য-প্রাণ-পুষ্টি-সামর্থ্য সব বিসর্জন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করত।
‘কথা ছিল, আমাদের কাজ শেষ করার
দিনমান হাড়ভাঙা খাটুনি দেয়নি ক্লান্তির বেশি কিছুই
কোনোমতে বেঁচে থাকা ছাড়া দেয়নি কিছুই
কখনো ভাববার জন্য জোটেনি একটা ঘণ্টাও
আমরা দেখতে চাই সূর্যের আলো, চাই প্রাণ ভরে নিতে ফুলের গন্ধ
জানি ঈশ্বরও চেয়েছে তাই, আমাদের আট ঘণ্টা পাওনা তাই
দোকান, শিপ-ইয়ার্ড, মিল-কলকারখানা সব জায়গা থেকে সবাই একসাথে চাইছি, সব শক্তি নিয়ে ডাকছি
আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম আর আট ঘণ্টা আমাদের যা ইচ্ছা তাই’
[দিনে আট ঘণ্টা—গানের কথা]
শিকাগো শহরে মে দিবসের শ্রমিক নির্যাতন-গ্রেফতারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সারা দুনিয়ার শ্রমিক আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষভাবে ইতালি-ফ্রান্স, স্পেন-হল্যান্ড, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডে শ্রমিকরা আমেরিকায় গ্রেফতার হওয়া শ্রমিকদের প্রাণ বাঁচাতে দুনিয়ার নানা প্রান্তে লড়াই সংগ্রাম সংহতি গড়ে তোলে। কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে ফাঁসিতে ঝোলায় আন্দোলনের নেতা আগস্ট সিজার, ফিশর, এঞ্জেল, স্পাইসকে।
১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্যারিসে শ্রমিকদের দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেইখানেই আমেরিকার শিকাগোর প্রতিবাদে সারা দুনিয়ায় পালনের তা সিদ্ধান্ত হয়। তারপর থেকে মে দিবস আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়। কিন্তু যেখানে মে দিবসের সূত্রপাত সেই আমেরিকায় এখনো মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় না। ৪ সেপ্টেম্বর তারা শ্রম দিবস পালন করে।
সাম্প্রতিক মে দিবসের ইতিহাস স্মরণ করতে গিয়ে পোশাক আন্দোলনে গুলিতে নিহত—আঞ্জুয়ারা, রাসেল, ইমরান ও জামাল উদ্দীনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিক আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পুলিশের গুলিতে-আগুনে প্রাণ হারায় তারা। গ্রেফতার হয় শত শত শ্রমিক। দমন করার চেষ্টা ইতিহাসে বরাবরই দেখা যায়।
এসব পরিস্থিতিতে মে দিবস আমাদেরও নতুন করে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা দেয়। যে লড়াই কেবল কাগজে বা আইনি ৮ ঘণ্টা নয় বরং ৮ ঘণ্টা কাজে, মর্যাদায়, জীবন যাপনের মজুরির দাবিকে যুক্ত করে এগোনোর প্রয়োজনীয়তা সামনে আনে।
তাসলিমা আখ্তার ।। সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রী
taslimaakhter1971@gmail.com