ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি, ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৪ এপ্রিল ২০২৪, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) এক প্রজ্ঞাপনে এই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৪৯(১)(গ), ৭৭(১৬) এবং কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর ধারা ২২৮ ও ২২৯-এর বিধান মোতাবেক কোনো ব্যাংক-কোম্পানি কর্তৃক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক কোম্পানির সঙ্গে একীভূতকরণের মাধ্যমে আর্থিকভাবে অধিকতর সবল ব্যাংক গঠন করতে পারবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, খারাপ অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো নিজ থেকে একীভূত না হলে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূতকরণ করা হবে। এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একইসঙ্গে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, যাতে করে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক-কোম্পানি অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৮ মার্চ ২০২৪ এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে সমঝোতা স্মারক সই করেছে পদ্মা ব্যাংক। তাছাড়া, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক—এই ৬ সরকারি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরই মধ্যে, সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)-কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একীভূত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আলোচনা শেষ করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যেই আরও ৫ থেকে ৭ দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঘোষণা আসবে। বাজারে গুঞ্জন আছে যে, একীভূত তালিকায় যুক্ত হতে পারে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সাথে সরকারি বেসিক ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক। পরবর্তী দুটি ব্যাংকই বেসরকারি ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে ৪৫-তে নামিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একীভূতকরণের উদ্যোগকে সামনে রেখে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে তোলার পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক [Prompt Corrective Action Framework]’ শীর্ষক এক সার্কুলার জারি করে। ঐ সার্কুলারে বলা হয় যে, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ থেকে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক কার্যকর হবে।

পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক-এর আওতায় মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ, তারল্য ও সুশাসনের ঘাটতিসহ বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংকগুলো চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।

এর মধ্যে ৩ ও ৪ শ্রেণিভুক্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য এক বছর সময় দেওয়া হবে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আর্থিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে সেইসব ব্যাংককে বাধ্যতামূলক একীভূত করার উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

একীভূতকরণের পূর্বে ব্যাংকদ্বয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এরপর, বিস্তারিত পরিকল্পনা করে আমানতকারী, পাওনাদার ও বিনিয়োগকারীর অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া জমা দিতে হবে। অতঃপর বাংলাদেশ ব্যাংক বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক মূল্যায়ন করাবে। সর্বশেষে, আদালতের কাছে একীভূতকরণের আবেদন করে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ব্যাংক একীভূতকরণ সম্পন্ন হবে।

দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে ৪৫-তে নামিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নীতিমালা অনুযায়ী, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মীদের ৩ বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না। তবে ৩ বছর পর কর্মীদের কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক। এমনকি একীভূত হওয়ার আগে কর্মীরা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন, সেই একই বেতন ও শর্তে তাদের বহাল রাখতে হবে।

ব্যাংকাররা বলছেন, এই বিধানের ফলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে একধরনের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। কেননা, ব্যাংকে প্রতিবছর কর্মীর কার্যমূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু নীতিমালায় খারাপ ব্যাংকের কর্মীদের ৩ বছরের জন্য চাকরি ও আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। অথচ, ভালো ব্যাংকের কর্মীরা প্রতিবছর তাদের কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবেন।

একীভূত হওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকরা তাদের পদ হারাবেন। এমনকি ৫ বছরের মধ্যে কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। তবে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের পরিচালকদের পাঁচ বছর পর আবার পর্ষদে ফেরার সুযোগ পাবেন। অনেকের মতে, এই সুযোগ একধরনের দায়মুক্তি। অথচ ব্যাংকে আর্থিকভাবে দুর্বল করার জন্য নামে বা বেনামে ঋণ বিতরণে পরিচালকরাই প্রধান দায়ী। আর ব্যাংক খাতের সুশাসনের ক্ষেত্রে এটা বড় সমস্যা হতে পারে।

বিলুপ্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক একীভূত ব্যাংকের কোনো পদে থাকতে পারবেন না। তবে, একীভূত ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্তির পর উপযুক্ত মনে করলে নতুন করে চুক্তির ভিত্তিতে এদের কোনো পদে নিয়োগ দিতে পারবে।

কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হলে ৩ বছর পর্যন্ত পৃথক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন করতে পারবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে ৩ বছর পর সমন্বিত আর্থিক বিবরণী তৈরি করতে হবে। স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়া ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হওয়া ব্যাংকের ব্যক্তি আমানতকারীরা আগে টাকা ফেরত পাবেন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগ একটি প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংকের স্বাস্থ্য সূচক গণমাধ্যম তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয় যে, প্রাইম, যমুনা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ ১৬টি ব্যাংক রয়েছে ভালো অবস্থায় অর্থাৎ গ্রিন জোনে। আর এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। সোনালীসহ ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টির মধ্যে ৩ ব্যাংক রয়েছে রেড জোনের খুব কাছাকাছি। ১২টির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যার মধ্যে পদ্মা, বেসিক, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, ন্যাশনালসহ ৯টি ব্যাংক আছে রেড জোনে।

একীভূতকরণের উদ্যোগ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত গ্রাহকদের মনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে, দীর্ঘমেয়াদি বড় অঙ্কের আমানত গ্রাহকরা বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন। ভবিষ্যতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের কোনো সমস্যা হবে কিনা সেই বিষয়ে অনেকে আস্থাহীনতায় ভুগছেন।

এইসব কারণে, তাদের অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। যদি বাস্তবেই, একসাথে অনেক আমানতকারী তাদের গচ্ছিত টাকা উত্তোলন করে নেন, তাহলে দুর্বল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার আগেই আরও আর্থিক সমস্যায় নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। সমাধানের আগেই সমস্যার আরও তীব্রতা বৃদ্ধি কারও কাম্য নয়। ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনি সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে ২-৩ বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অতি সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে হবে।

বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। অর্থ পাচার হয়েছে। যা অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো। আইএমএফ-ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চাইছে দীর্ঘদিন ধরে।

অন্যদিকে দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকগুলোর সাথে বাধ্যতামূলক একীভূত করার কারণে ভালো ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ, যে প্রক্রিয়ায় এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, তাতে ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর খারাপ ব্যাংক চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। কেননা, ব্যাংকের নথিপত্রেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর দ্বিগুণ হবে বলে অনেকের ধারণা।

তাই, বিশেষজ্ঞদের মতে ভালো কোনো ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে সবার আগে। চাপ দিয়ে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে তার ফল ভালো নাও হতে পারে।

কেননা, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে বিডিবিএল গঠন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে, দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিডিবিএল এখনো খেলাপি ঋণে ধুঁকছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিডিবিএলের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এখন, একে সোনালী ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণের চেষ্টা চলছে।

এছাড়া যে এক্সিম ব্যাংকের সাথে পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেই এক্সিম ব্যাংক নিজেই ইয়োলো জুনে অর্থাৎ খুব ভালো অবস্থায় নেই। এমনকি আলোচনায় আসা যে সিটি ব্যাংকের সাথে বেসিক ব্যাংকের একীভূতকরণের প্রচেষ্টা চলছে সেই সিটি ব্যাংক কয়েক বছর আগে নিজেও দুর্বল অবস্থায় ছিল।

ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, এভাবে একীভূত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না। কারণ, এই কৌশলের সাফল্য নির্ভর করবে কোন ধরনের ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে তার ওপর। একীভূতকরণের পর অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের অবস্থা যাতে খারাপ না হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা, সুশাসনের অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা চলছে। এনপিএল বা খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতকে গ্রাস করছে রাহুর মতো।

পরিসংখ্যান বলছে, মোট ঋণ এবং অগ্রিমের সাথে মোট এনপিএল-এর অনুপাত ২০২০ সালে ছিল ৭.৭ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৭.৯ শতাংশ। পরবর্তীতে, ২০২২ সালে ৯ শতাংশে এবং ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ১০.১১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। ব্যাংকটির মতে, ঋণের অপর্যাপ্ত মূল্যায়ন, ফলোআপ এবং তত্ত্বাবধান এনপিএল বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী।

বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। অর্থ পাচার হয়েছে। যা অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো। আইএমএফ-ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চাইছে দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের ব্যাংকিং খাতে কার্যকর ঋণ পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ এই দুই জায়গাতেই ব্যাপক গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বারবার আলোচনায় আসার পরও তা প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ঋণ বিতরণ থেকে আহরণ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক গোষ্ঠী স্বার্থে দৌরাত্ম্য ও সুপারিশের বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া ঋণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সবার সামনেই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে দিনের পর দিন। তাই এখনো অনেকে ভাবেন, ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।

আমাদের ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করার জন্য সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ ও ভর্তুকি উভয়েই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষে ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার ব্যাংক ঋণের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ঋণের জন্য সরকারের অতি নির্ভরশীলতা ব্যাংককে দুর্বল করেছে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার তথ্যমতে, জ্বালানি সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির দায় বাবদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো পাবে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো।

ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থ বকেয়া পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাংক ও গ্রাহকরা। এই অবস্থায় ভর্তুকি পরিশোধে বিকল্প পথ হিসেবে সরকার ব্যাংকের পাওনার বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু করছে। এই ধরনের বন্ড ব্যাংকের তারল্য সমস্যার সমাধান করে না। কেননা, ব্যাংক কোনো নগদ অর্থ হাতে পায় না। ফলশ্রুতিতে, বড় অঙ্কের গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রাহকরাও আছে দুশ্চিন্তায়।

শুধু ব্যাংক একীভূত করেই ব্যাংক খাত ঠিক করা যাবে এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। আজকে ব্যাংকিং খাতের যে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও সংস্কারহীনতার ফসল। তাই আর অপেক্ষা নয়। এখন সময় এসেছে, পারিবারিক দৌরাত্ম্য কমিয়ে ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার। খেলাপি ঋণের জন্য দায়ীদের বের করে শাস্তির আওতায় আনার।

রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য ও সুপারিশ বিবেচনা পরিহার করে উৎপাদনশীল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ব্যাংকের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়ার। সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের। ঋণ বিতরণ, ব্যবহার ও আহরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার। ঋণ পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে কঠোরতা ও গতিশীলতার সমন্বয় নীতির সঠিক বাস্তবায়নের।

পরিশেষে, ব্যাংক একীভূতকরণের ভালো ইতিহাসও আছে। যেমন ২০০০ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক একীভূত হয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ নামে। ২০০১ সালে ব্যাংক অব নোভা স্কটিয়ার ব্যবসায়িক কার্যক্রম অধিগ্রহণ করে ব্যাংক এশিয়া। পরবর্তীতে, ব্যাংকটি মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের কান্ট্রি অপারেশনও অধিগ্রহণ করে। কাজেই এখন দেখা যাক, এই উদ্যোগ আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবসায় দুর্বলতা কাটিয়ে কতটুকু সফলতা নিয়ে আসে।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়