ছবি : সংগৃহীত

চলতি এপ্রিল মাসে অন্তত ২৩ দিন দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে যা ৭৬ বছরের তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অন্তত টানা দুই দিন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তা তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তীব্র তাপপ্রবাহে কেবল জনজীবন অস্বস্তিকর নয়, রাস্তাগুলোও বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইরানসহ বিশ্বের গবেষকরা উষ্ণ আবহাওয়া সড়ক দুর্ঘটনাকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন।

গবেষকরা বলেছেন, গরম আবহাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যা ভবিষ্যতে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

 

অতিরিক্ত গরমে আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক এই উত্তপ্ত পরিবেশের সাথে সামলাতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে। মানুষ তৃষ্ণার্ত, তন্দ্রাচ্ছন্ন এবং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে ওঠে যা তার স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকে বাধাগ্রস্ত করে। এমন অবস্থায় গাড়ি চালানো অত্যন্ত বিপজ্জনক।

সূর্যের প্রখর তাপে গাড়ির ভেতরে তাপ আটকে থাকে। তা আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। তাই এই গরমের মধ্যে গাড়ির ভেতরের উত্তপ্ত পরিবেশ ড্রাইভার এবং যাত্রী উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তীব্র তাপদাহে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪.৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যারা গরমের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের লেনে থাকতে, ট্রাফিক সিগন্যাল দেখতে এবং রাস্তায় যা ঘটছে তার সাথে দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে বেশি সমস্যা হয়।

তাছাড়াও তীব্র তাপদাহে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চললে ইঞ্জিন ওভার হিটিং হয়ে গাড়ি বিকল বা অগ্নিসংযোগের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রচণ্ড গরমে রাস্তার পিচ বা বিটুমিন গলে গিয়ে রাস্তা থেকে উঠে আসে। পাশাপাশি উত্তপ্ত নরম বিটুমিন গাড়ির চাকার সাথে আঠার মতো লেগে গিয়ে গাড়ির গতি হ্রাস করে, অন্যদিকে পিচ গলা রাস্তার সাথে চাকার গ্রিপ কমে যায় যার ফলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়, তখন রাস্তায় গাড়ি চালানো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে, এমনকি অ্যাথলেটরা গরমে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য দাবদাহ কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। পার্কিং অবস্থায় গাড়ির ভেতরে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। যদি একটি গাড়ির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রি বা তার বেশি হয় তবে এটি যে কারও জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই বিশেষ করে তাপদাহের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।

যদি আপনি গাড়ির ভেতরের অতিরিক্ত গরম পরিবেশে বেশিক্ষণ থাকেন তবে তা আপনার ড্রাইভিংয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তীব্র তাপদাহে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪.৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যারা গরমের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের লেনে থাকতে, ট্রাফিক সিগন্যাল দেখতে এবং রাস্তায় যা ঘটছে তার সাথে দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে বেশি সমস্যা হয়।

এছাড়া দাবদাহে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। প্রতিটা ট্রেনে অসংখ্য যাত্রী যাতায়াত করে। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার কারণে যদি ট্রেন, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাহলে হতাহতের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। এরমধ্যে পাবনার ঈশ্বরদী বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি রেললাইনের পাত বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। (ঢাকা পোস্ট, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)

এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, গরম আবহাওয়ায় রাস্তায় নিরাপদে গাড়ি চালানোর জন্য আমরা কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারি। যেমন, সড়কের দুই ধারে ও সড়ক বিভাজনে ছায়া প্রদানকারী গাছ লাগানো যেতে পারে।

বিটুমিনের সাথে পোড়া মবিলের ব্যবহারের ফলে রাস্তার পিচ গলে যায় এবং তা চাকার সাথে উঠে আসে। এর ফলে গাড়ির গতিও কমে যায় এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

পার্কিং লটে ছায়ার জন্য গাছ লাগাতে পারি যা গাড়িকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করতে পারে এবং গাড়ির জানালায় শেড ব্যবহার করলে সূর্যের তাপ কিছুটা আটকাতে পারে।

গাড়িতে এসি থাকলে নিয়মিত এয়ার ফিল্টার বদলাতে হবে এবং ইঞ্জিন যাতে ওভারহিটিং না হয় তার জন্য ভালো মানের কুল্যান্ট (Coolant) ব্যবহার করতে হবে। এসবের পাশাপাশি ওষুধ বা চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাপের প্রতি বেশি সংবেদনশীল কিনা তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ।

গাড়ি চালানোর সময় খুব গরম অনুভব করলে, মাঝে মাঝে ছায়া যুক্ত স্থানে বিরতি নিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। বিটুমিনের সাথে পোড়া মবিলের ব্যবহারের ফলে রাস্তার পিচ গলে যায় এবং তা চাকার সাথে উঠে আসে। এর ফলে গাড়ির গতিও কমে যায় এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই বিটুমিনের সাথে ভেজাল দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

তাপদাহের প্রভাব থেকে সাময়িক রেহাই দিতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১০টি জোনে পানি ছিটাচ্ছে, দুটি স্প্রে কামান ও দশটি বাউসার ব্যবহার করে প্রায় ৪০০,০০০ লিটার পানি ছিটাচ্ছে যা পরিবেশের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রির মতো কমিয়ে আনতে সক্ষম।

যদিও গরম ড্রাইভিংকে বিপজ্জনক করে তুলতে পারে, কিন্তু ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয়ে এবং নিরাপদে থাকার জন্য সহজ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে আমরা রাস্তায় নিজেদের এবং অন্যদের রক্ষা করতে পারি। সর্বোপরি, কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই গন্তব্যে নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে পারি।

সুদীপ্ত সাহা ।। প্রভাষক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট