ছবি : সংগৃহীত

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। ২০২৪ সালে ঈদের লম্বা ছুটি পড়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণগুলোয় ঘুরতে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। মূলত আমরা সবাই কম বেশি ঘুরতে পছন্দ করি। আবার অনেকে স্বল্প সময়ে দুই/এক দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনায় ঢাকার আশেপাশে রিসোর্ট ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণগুলো প্রাধান্য পায়।

ঈদের সময় বাঙালিরা সাধারণত পরিবার-পরিজন নিয়ে বিনোদন ও অবকাশ যাপনের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়। ঈদের ছুটিতে মানুষ নাড়ির টানে ছুটে চলে বাড়ি তাই গ্রাম হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল আর শহর থাকে প্রায় জনশূন্য। অনেকে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদযাপনের জন্য জন্য শহরের কৃত্রিম ব্যস্ততা ঘেরা পরিবেশ ছেড়ে মানুষ মাটির টানে ছুটে চলে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ভ্রমণ মানুষের ক্লান্তি দূর করে, মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়, সেই সাথে কাজের গতি বাড়াতে সহায়তা করে; যা সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক।

ঈদকে কেন্দ্র করে ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলো দেশে ও বিদেশ ভ্রমণের নানাবিধ আকর্ষণীয় ট্যুর প্যাকেজ দেশ ও বিদেশের জন্য অফার করে। তার মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটক ও তরুণ পর্যটকদের কাছে প্রথম পছন্দ বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করার নান্দনিক আকর্ষণ কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ছাড়াও উচ্চ মধ্যবিত্তদের পছন্দ পাশের দেশ ভারতের কলকাতা, শিমলা, মানালি ও কাশ্মীর, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিসর ও মালদ্বীপ।

ঈদের সময় ভ্রমণ ও বিনোদনের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তদের পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ফ্র্যান্স, ইতালি, ভ্যাটিকান সিটি, প্রাগ, মরিশাস, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ।

করোনার তাণ্ডব থেকে বের হয়ে আসতে না আসতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে এবার পর্যটকরা দেশীয় পর্যটনে ঝোঁক বাড়ছে। এই প্রবণতা অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারণ ও ঈদকে কেন্দ্র করে দেশীয় পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনায় জেগে উঠছে।

এবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঈদের ছুটিতে মানুষ বিদেশ ভ্রমণের চেয়ে দেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণগুলোয় ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ বেশি কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধি ও বিমানের টিকিটের দাম অন্য বছরের তুলনায় চড়া। এসব বিষয়াদি বিবেচনা করে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ভ্রমণপিপাসুরা বিদেশের পরিবর্তে দেশের আকর্ষণীয় স্পটগুলোর জন্য বুকিং দিচ্ছেন। যা দেশীয় পর্যটন উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এক সুখকর বার্তা।

বর্তমানে পর্যটন খাত থেকে জিডিপির অবদান ৩ শতাংশ এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই শিল্পে কর্মরত আছেন। তবে দেশের মানুষ যত বেশি দেশের মধ্যে ঘুরবে, দেশের টাকা ততই দেশে থাকবে...

বর্তমানে পর্যটন খাত থেকে জিডিপির অবদান ৩ শতাংশ এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এই শিল্পে কর্মরত আছেন। তবে দেশের মানুষ যত বেশি দেশের মধ্যে ঘুরবে, দেশের টাকা ততই দেশে থাকবে; এর দ্বারা আগামী চার-পাঁচ চলতে থাকলে পর্যটন খাতে জিডিপি অবদান গিয়ে দাঁড়াবে ৫ শতাংশের ওপরে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের; সেইসাথে তরুণ উদ্যোক্তারা পর্যটন খাতে ক্যারিয়ার গঠনে উৎসাহিত হবে।

ঈদুল ফিতর ও বৈশাখী বরণকে কেন্দ্র করে মিলছে লম্বা ছুটি। এই ছুটিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের সমাগম হবে পর্যটন রাজধানীতে। ঈদ ও বর্ষবরণকারী পর্যটকদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও সাত শতাধিক রেস্তোরাঁ।

ঈদের ছুটিতে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রমণ ও বিনোদনের জন্য ইতিমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যটন অঞ্চলের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও থিম পার্কগুলোয় প্রায় আশি শতাংশ সিট বুকিং হয়ে গেছে। ঈদের সময় যেহেতু পর্যটক সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ‘পর্যটন ব্যবস্থাপনা’ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন।

নিরাপদ জোরদার করার মধ্য দিয়ে পর্যটক আস্থা অর্জন হয় যা ঈদের সময় অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারণ হয় বিধায় দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধ হয়।

ঈদের এক-দুই দিন আগ থেকে কক্সবাজার রুটে চাপ বেড়ে যায়। ঈদের পরের দিন থেকে চাহিদা বৃদ্ধি পায় বিধায় কক্সবাজারে দৈনিক ২০টি ফ্লাইট রাউন্ড ট্রিপে থাকে। অন্যদিকে সৈয়দপুর, খুলনা, সিলেট রুটেও বিমানের টিকেটের চাহিদা বেশি থাকে বিধায় এয়ার টিকেটের দাম বেড়ে যায়।

এছাড়া জেলা ভিত্তিক পর্যটন প্রসারের জন্য বাই রুটেও এবারের ঈদে ছুটিতে যাত্রী ও পর্যটকদের বাসের টিকিটের চাহিদা বেশি। তাই টিকিটের দাম আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এয়ার ও বাসের টিকিটের ভাড়া যেন পর্যটকদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে সেইজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তদকারী কমিটি গঠন করা দরকার।

পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিওনে প্রথমবারের মতো সমুদ্র সৈকতে ইন্টারকম ও ইমার্জেন্সি বাটন স্থাপন করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। যার মূল উদ্দেশ্য হলো পর্যটকরা কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষকণিক অভিযোগ করতে পারবেন।

উৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের জন্য আবাসন কক্ষগুলোর মূল্য, খাবারের দাম, পর্যটন পণ্যের মূল্য যেন অহেতুক না বাড়ায় সেই লক্ষ্যে পর্যটন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তদারকি প্রয়োজন।

প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকে দেখা ও মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা যাদের তারা ঘুরে আসতে পারেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, মেঘলা, শৈলপ্রপাত। অন্যদিকে অপরূপ সুন্দর জেলা খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা ও ঝর্ণা, রিচাং ঝর্ণা, রামনগর লেক, ও চা বাগান এবং রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, সাজেক ভ্যালি, ঝুলন্ত সেতু ও বৌদ্ধবিহার।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সব মানুষের প্রিয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ ইতিহাস। এই অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসীদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি যা কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটনে অন্যতম।

এছাড়াও চা বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, তামাবিল, পাহাড়, ঝর্ণা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার এই সিলেট দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন নগরী।

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু সাগরকন্যা কুয়াকাটার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন।

চরফ্যাশন ভৌগলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সুন্দর, নদী বেষ্টিত এবং সাগরের নৈকট্য এক ভিন্নরকম সৌন্দর্যের স্বাদ দেবে ভ্রমণ পিপাসুদের। এখানে নতুন জেগে ওঠা চরগুলো প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চরফ্যাশনের দক্ষিণে সাগর মোহনার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুকরি-মুকরি, ঢালচর, তারুয়া সৈকত প্রাকৃতিক পর্যটনের এক নব দিগন্ত।

পর্যটক সেবা আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার জন্য ফাইভ স্টার চেইন হোটেলগুলোয় অগমেন্টেড রিয়ালিটি ও ইন্টারনেট অফ থিংস এর সুযোগ থাকতে হবে। দেশীয় পর্যটনকে প্রসারের লক্ষ্যে দেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর থ্রিডি ভিডিও ও কনটেন্টযুক্ত ডকুমেন্টারি প্রচারের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পর্যটনের সুফল সম্পর্কে জানানো ও ভ্রমণেও উৎসাহিত করা সম্ভব।

উৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের জন্য আবাসন কক্ষগুলোর মূল্য, খাবারের দাম, পর্যটন পণ্যের মূল্য যেন অহেতুক না বাড়ায় সেই লক্ষ্যে পর্যটন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তদারকি প্রয়োজন। দেশের পর্যটন উন্নয়নে জেলাভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো পরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই পর্যটন উন্নয়ন বাস্তবায়িত হবে।

ঈদের সময় পর্যটকদের মানসম্মত সেবা প্রদানের জন্য হোটেলের ইন্টেরিয়র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব দিকে খেয়াল রাখা দরকার, এমনকি হোটেল ও মোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ, বিচ পরিষ্কার থেকে বিচ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

ঈদের ছুটিতে পর্যটকরা যেন হয়রানি না হয় তার জন্য টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশ একসাথে হয়ে কাজ করলে পর্যটক ভোগান্তি কমবে। হোটেল মালিক সমিতির সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দরকার, কোনো হোটেল যদি অতিরিক্ত ভাড়া নেয় ও অভিযোগ পাওয়া যায়  তার সদস্য পদ বাতিল করা হতে পারে। পর্যটকদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে পর্যটন কর্মীদের সেবা প্রদানে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা ও গুনগত মানের সেবা প্রদানের জন্য ট্রেনিং দরকার।

অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব ।। চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়