ছবি : সংগৃহীত

তবে কি আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে আবারও অস্থিরতা ফিরতে শুরু করেছে? বিষয়টি ঠিক এই রকম কিনা আমরা জানি না, তবে শঙ্কা আছে। ২ ও ৩ এপ্রিল ২০২৪ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ ব্যাংক ডাকাতি করে এই জনপদে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ২ এপ্রিল ২০২৪ রাতে বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি করে ত্রাস সৃষ্টি করে ১৬ ঘণ্টা না পেরোতেই ৩ এপ্রিল ২০২৪ বান্দরবানের আরেক উপজেলা থানচির কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে দিনদুপুরে টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

ঘটনা যা জানা গেল—২ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হামলার সময় পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র নিয়ে যায়। তবে ব্যাংকের ভল্ট ভাঙতে না পারায় টাকা নিতে পারেনি বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। এখনো তার সন্ধান মেলেনি।

সোনালী ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির আগে ব্যাংকের পাশে অবস্থিত মসজিদের মুসল্লিদেরও কিছু সময়ের জন্য জিম্মি করে রাখে কেএনএফ সদস্যরা। সেইখান থেকেই তারাবি নামাজ পড়া অবস্থায় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন তারা বান্দরবানের আরেক উপজেলা থানচির কৃষি ও সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পরপর এই রকম দুটি ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের প্রতি কুকিদের ভয়ংকর বার্তা হিসেবেই দেখছে।

১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারের উদ্যোগে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে। তবে পাহাড় যে একবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিল তা বলা যাবে না। পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সাথে ইউপিডিএফসহ নানা সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মাঝে মাঝেই এই জনপদ রক্তাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।

আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর আছে পরিস্থিতি মোকাবিলায়। কিন্তু প্রকাশ্যে জনপদে ঢুকে ব্যাংক ডাকাতি করা, ম্যানেজার ধরে নিয়ে যাওয়া, এলাকায় নিজেদের এই রকম সশস্ত্র উপস্থিতি জানান দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে না কোনো মহলেই।

...প্রকাশ্যে জনপদে ঢুকে ব্যাংক ডাকাতি করা, ম্যানেজার ধরে নিয়ে যাওয়া, এলাকায় নিজেদের এই রকম সশস্ত্র উপস্থিতি জানান দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে না কোনো মহলেই।

অনেকদিন ধরেই এদের তৎপরতা সম্পর্কে শোনা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ছবিও দিয়ে যাচ্ছে তারা নিয়মিত। ফেসবুকে ছবি দিয়ে বলছে, আজকের কেএনএফ-এর বিশেষ কমান্ডো টিম-যে টিমটি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে পাহাড়িদের এই সংগঠনটির সামরিক শাখা হিসেবে কাজ করে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফ ও এর সামরিক শাখা কেএনএ তৎপরতা শুরু হয়। সেই থেকেই আলোচনায় এই সংগঠনটি। প্রথমে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ নিয়ে, আর এখন ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে।

রাঙামাটির সাজেকের বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবানের রুমা রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্য দাবি করে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে এই সংগঠন। তবে নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বলেনি কখনো।

তাদের দাবি, সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ নয়। পাহাড়ের বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সজাগ। বড় অভিযোগ এইটাই যে, এই সংগঠনটি পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে মদদ দেয় এবং এসব কারণে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়।

প্রায় এক বছর আগে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আলোচনায় আসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এরপর দুর্গম পাহাড়ের গভীর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে শান্তি আলোচনাও শুরু করে। ২০২৩ সালে ধারাবাহিকভাবে বান্দরবানে কেএনএফ বিরোধী অভিযানের পর থেকে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছিল কড়া নজরদারি। এর মধ্যে এমন দুঃসাহসিক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের এমন বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে পার্বত্য অঞ্চলের জনজীবনে নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি এসব সংগঠন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কুকি-চিনের পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো মদদ রয়েছে কি না, সেইটিই এখন বড় ভাবনা।

....কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বান্দরবান জেলা পরিষদের উদ্যোগে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয় ২০২৩ সালের মে মাসে।

প্রায় বছরখানেক আগে পাহাড়ে আস্তানা গড়া জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই সময় কেএনএফ নেতাসহ বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিল হিন্দালের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পায়।

সেই সময় র‌্যাব জানায়, অর্থের বিনিময়ে কেএনএফ জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে আস্তানা গাড়তে সহায়তা করেছে। ওইসব আস্তানায় তারা সংগঠনটির জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিতো। পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। ওই সময় কেএনএফের হামলায় একাধিক সেনাসদস্যও নিহত হন।

তারপর কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে বান্দরবান জেলা পরিষদের উদ্যোগে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয় ২০২৩ সালের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়। এর মধ্যেই ব্যাংক ডাকাতির করে কুকি-চিন।

আগেই বলেছি যে, ২০২২ সালের পর পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে মদদ এবং নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষে জড়ায় সংগঠনটি। সাধারণ পর্যটক থেকে থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অনেকেই তাদের হাতে অপহরণের শিকার হন।

পাহাড়ে এক আতঙ্কের নাম এই সংগঠনটি। আতঙ্কে থেকে এই জনপদকে মুক্ত করতে হবে। এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি। তাই এখানে গভীর দৃষ্টি দেওয়াই জরুরি।

তিন দেশের সীমান্তের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে বান্দরবানের এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। শুধু পুলিশের উপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে আবারও এই অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা যায় কিনা ভাবতে হবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন