ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি দেশে দুটো ব্যাংকের একীভূতিকরণ (Merger/Amalgamation of Banks) ঘটেছে—এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে আত্মভূত করেছে। বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যই এটা করা হয়েছে।

পদ্মা ব্যাংকের কর্মচারীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তাদের চাকরি সুরক্ষিত এবং কাউকেই ছাঁটাই করা হবে না। সেই সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদেরও বলা হয়েছে যে, তাদের আমানত নিরাপদ। সার্বিকভাবে স্থিতিশীল পরিস্থিতির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

সারা বিশ্বে ব্যাংক, শিল্প কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ নতুন কিছু নয়। নানান অর্থনীতিতে নানান সময়ে এটা ঘটেছে—বিশেষ করে অর্থনৈতিক টালমাটালের সময়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময়েও এটা আমরা লক্ষ্য করেছি।

সাধারণত তিনটা কারণে এই জাতীয় একত্রীভূতিকরণ বা একীভূতকরণের ঘটনা ঘটে—

এক, ক্ষমতার বলয় প্রসারণের জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট প্রতিষ্ঠানদের আত্মভূত করে থাকে;

দুই, প্রতিযোগিতাকে হ্রাস করে একচেটিয়া বাজার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠান গ্রাস করে;

এবং তিন, আর্থিক সমস্যাসংকুল নানান প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যান্য ভালো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করে বাজারে স্থিতিশীলতা ও আস্থা নিশ্চিত করা হয়।

পদ্মা ব্যাংকের কর্মচারীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, তাদের চাকরি সুরক্ষিত এবং কাউকেই ছাঁটাই করা হবে না। সেই সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদেরও বলা হয়েছে যে, তাদের আমানত নিরাপদ।

এর পরিপ্রক্ষিতে, প্রশ্ন উঠেছে যে, এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের একত্রীভূতিকরণ ঘটল কেন? অনেকেই বলছেন যে, বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং খাতে যে সমস্যাসমূহ এবং অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান, তা হ্রাস করার জন্যই এই একত্রীভূতিকরণ।

সেই সঙ্গে এটাও বলা হচ্ছে যে, অর্থনীতিতে আস্থা বৃদ্ধির জন্যে এর প্রয়োজন ছিল। কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে, পদ্মা ব্যাংককে বাঁচানোর জন্যই এই পদক্ষেপ।

এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো নয়। ব্যাংক যদি গণেশ ওল্টায়, তাহলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

সাধারণভাবে, বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহের একীভূতকরণ সম্পর্কে পাঁচটি কথা মনে রাখা দরকার—

প্রথমত, প্রতিযোগিতা ও দক্ষতার নিয়মে সাধারণ কোনো ব্যাংক যদি আর্থিক দিক থেকে অকৃতকার্য হয়, তাহলে তাকে স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হতে দেওয়া ভালো। যদি না সেই ব্যাংকটি এমন বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হয় যে তার মৃত্যু পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার সামষ্টিক স্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যাংকের একীভূতকরণ যদি একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হয়, তবে তা পরিত্যাজ্য। একচেটিয়া বাজার গ্রাহককে প্রতিযোগিতামূলক সেবা দেবে না এবং এর ফলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিভিন্ন ব্যাংকের একীভূতকরণ যদি একচেটিয়া বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হয়, তবে তা পরিত্যাজ্য....

সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণ ঘটলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও কী রকম প্রভাব ফেলবে, তাও মূল্যায়িত হওয়া দরকার।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বর্তমান ব্যাংকিং খাতে যেসব মৌলিক সমস্যা রয়েছে, তার জন্য কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সেইসব কষ্টকর কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিকল্প একীভূতকরণ হতে পারে না।

চতুর্থত, ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণ ঘটলে দুর্বলতর ব্যাংকটির কর্মীদল, তাদের কর্ম নিরাপত্তা, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত, অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাতের অনুকূল সংখ্যা আছে। মোট ব্যাংকের সংখ্যা সেই সংখ্যাকে অতিক্রম করে গেলে সেই জায়গায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নাজুক পরিস্থিতি ও অস্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও কেন নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচিত হওয়া প্রয়োজন।

অন্য ভাষায়, একীভূতকরণের (অর্থাৎ ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা) মাধ্যমে যখন ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেইখানে নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমোদনের যৌক্তিকতা কোথায়?

ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের জন্য নতুন। এর নানান মাত্রিকতা এবং সম্ভাব্য প্রভাব তাই সুষ্ঠুভাবে নিরূপিত হওয়া দরকার।

ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র