ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বরাতে জানা যাচ্ছে, ভারতীয় পণ্য বয়কটের যে কথা বলা হচ্ছে তাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা। দলটির নেতারা মনে করেন, নানা কারণে সাধারণ মানুষ ভারতের আচরণে ক্ষুব্ধ। তারা সেই ক্ষোভ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। তবে তাদের দাবি, এটি কোনো সংগঠিত আন্দোলন নয়। বরং বলা যায়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন।
তবে তাদের অনেক নেতাই আবার মনে করেন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হবে না, কারণ ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় গেলে কী করবেন।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে দলের যুক্ত হওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতা এই মনোভাব ব্যক্ত করেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ঘোষণা, তা কি দলীয় সিদ্ধান্তে। আর সিদ্ধান্তে হলে সেটা কোথায় হয়েছে। এটি নিয়েও তারা আলোচনা করেন।
সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরে আমরা দেখেছি। বিএনপিনেতাদের ভাষায় এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপমান, লাঞ্ছনা, ক্ষোভ থেকে এটি করছেন। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে আমাদের। আমাদের পক্ষে কি আদৌ ভারত বর্জন সম্ভব? ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে সরকারবিরোধী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এ আহ্বানে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিএনপিনেতারা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব। তবে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবস্থান স্পষ্ট করেনি বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে অনেকটা কৌশলে এগোচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
আরও পড়ুন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সভায় জানান, ভারতীয় পণ্য বর্জনের নামে বিএনপি এখন দেশের অর্জনকে ধ্বংস করতে চায়। তিনি উল্লেখ করেন, ‘পণ্য বর্জন এটা কি সম্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের যে অবস্থা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে লেনদেন, যে আদান-প্রদান হয়ে থাকে, তার মধ্যে এমন বর্জনের প্রস্তাব বাস্তব সম্মত কি না! আসলে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের নামে দেশের অর্জনকে ধ্বংস করতে চায়।’
বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার এই ধারা নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ধর্ম দিয়ে ভাগ করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করার এই ব্রিটিশ কৌশল বহু পুরোনো কৌশল ছিল। এই কৌশলে ব্রিটিশরা মানুষ হওয়ার আগে ভারতবাসীকে হিন্দু অথচ মুসলমান হিসেবে দেখিয়েছিল। তাদের কলোনিতে ফেলে আমাদের মাঝে একে অপরকে অপছন্দ করার এমন বিষবাষ্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে খানিকটা মাথায় ঢুকিয়েছিল যা প্রায় শতাব্দীর পথ পরিক্রমায় আমরা এর থেকে বের হতে পারিনি।
‘বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে আমরা এখনো পড়ে আছি এমন কিছু বিষয় নিয়ে যা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় আমাদের জীবনে, এমনকি পৃথিবীর জন্য। আমাদের মাথা থেকে প্রগতির কথা আধুনিকতার কথা, মানবতাবাদ এগুলো প্রায় বাদ দিয়েছি বা দিতে যাচ্ছি। এত উন্নয়ন ঘটছে কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ছি কিনা তা ভাবার সময় এসেছে। তাই আমাদেরও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মকাণ্ডে আরও একটু বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মুহূর্তেই মানুষের চিন্তা-চেতনা দৃষ্টি চলে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কিন্তু আমাদের মনের কালো আর ধর্মান্ধতা গেল না আর যাবেও না হয়তোবা কোনোদিন। কি বাংলাদেশ, কি ভারত, কি আমেরিকা, সুইডেন বা মিয়ানমার কেউ পিছিয়ে নেই। এখনো আমরা কেউ মানুষ নই, কেউ বা হিন্দু কেউ বা মুসলমান, কেউ বা খ্রিষ্টান কেউ বা বৌদ্ধ কেউ বা ইহুদি। তবে মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ তা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি যারা রয়েছে তাদের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই মনে হয়। মানবতাবাদ এদের কাছে কিছু নয়, নিজেদের স্বার্থই আসল। সাধু বা ভালো মানুষ সাজা বা ভান করার চেয়ে সাধু বা ভালো মানুষ হওয়াই উত্তম। এটি যদি সবাই মনে রাখতো তা হলে আমাদের সমাজ, পৃথিবী মানবজাতি আরও এগিয়ে যেতো।
আমাদের এই উপমহাদেশে দুই ধর্মের মানুষের বিরোধিতাজনিত মনোভাব সবসময় খুব শক্তিশালী। যখন যার দরকার সে তখন এটা ব্যবহার করে। শুধু আমরা সাধারণ মানুষেরা এটা বুঝতে পারি না। এখন চলছে ভারত বয়কট নামের প্রচার। ভারতীয় পণ্যের বিপরীতে আমার দেশের পণ্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশি পণ্য বলে যে কেউ তার পণ্য ক্রেতার সামনে এগিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেই দেশের পণ্য বর্জনের আহ্বান তো ন্যূনতম নৈতিক নয়।
কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোন পর্যন্ত মূল্যায়নের আওতায় আনা যাবে, এর একটা আন্তর্জাতিক প্রথা আছে। স্বাভাবিকভাবে দেখা হয় দেশটি সংবিধান কতটুকু জনবান্ধব? সেই সংবিধান অনুযায়ী দেশটি পরিচালিত হচ্ছে কি না। সবাই তাই দেখেছে।
আরও পড়ুন
যখন যার দরকার তখন আমরা ভারত বিরোধিতা শুরু করি। আবার অবসর কাটাতে ভারতে যাই। আসার সময় ভালো শপিং করতে পছন্দ করি, চিকিৎসা নিতে আমরা যাই। এটা হতেই পারে, এতে তো দোষের কিছু নেই। আমাদের বিনোদনের সময় ভারতের বাংলা ও হিন্দি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি, চিকিৎসার সময় কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা নিতে ভারতে যাই, কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতে যাই। এগুলোতে দোষের কিছু নেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই সুবিধাগুলো আমরা নিতেই পারি। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অবিশ্বাস্য হলেও তাই সত্য। বলা যায় প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে আছি আমরা। চামড়া, গার্মেন্টস, অটোমোবাইল, প্রযুক্তিসহ এরকম বহু সেক্টরে আমাদের ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বহু দেশ থেকে অনেক বেশি বেতনে, অনেক বেশি ডলার ব্যয় করে আমাদের জনশক্তি নিয়োগ দিতে হয়। এই খাতগুলোতে দক্ষ জনশক্তির আমাদের বড় অভাব।
তাছাড়া নিত্য পণ্য ও খাবারের চাল, গম এবং পেঁয়াজ আমদানিতে ঘাটতি হলে বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার সময় আমরা ভারতের সহযোগিতা চাই। ভারত সাধ্যমতো চেষ্টাও করে দিতো। আমাদের পোশাক শিল্পের সুতা আসে ভারত থেকে, ঔষধ শিল্পের অনেক কাঁচামাল আসে ভারত থেকে এই সামগ্রীগুলো ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আসে তাহলে, কাপড় ও ঔষধ কিনতে হবে ১০ গুণ বেশি দামে, তারপর ডলারের চাপ তো আছেই। যারা আজ ভারত বর্জন করতে বলছেন, তারা কখনও পারবেন এই সব পণ্য বর্জন করে দেশ চালাতে বা জনগণের প্রয়োজন মেটাতে?
ভারত সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে, মুক্তিযুদ্ধে, দেশ পুনর্গঠনে, অবকাঠামোতে উন্নয়নে সহযোগিতা করা, কোভিডের সময় এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে এবং সবসময়। বাংলাদেশের নিজস্ব যোগ্যতা অর্জনে ভারত কখনো বাধা দেয়নি। কিন্তু আমরা এই সহজ সত্যটি বুঝতে পারি না। তাই ভারত বয়কট কতটা সাফল্য দেশের জন্য বয়ে আনবে তাই বিজ্ঞজনদের নতুন একটি চিন্তার খোরাক জোগাবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, যারা ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করবে না বলে বর্জন করলেন, তাদের বউদের কতগুলো শাড়ি আছে? তারা কেন শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না? বউদের শাড়িগুলো পুড়িয়ে দিলে বুঝব সত্যিকারের পণ্য বর্জন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপির এক নেতা চাদর খুলে আগুন দিচ্ছেন যে, ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করবেন না। এরপর আবার দেখা গেল কিছু চাদর কিনে এনে পোড়ানো হলো। আচ্ছা শীতকাল তো চলে গেছে এখন আর চাদর পোড়ালে কী আসে যায়? বিএনপি নেতাদের বলব, যারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করবেন সবাই বাড়িতে গিয়ে তাদের বউরা যেন কোনো মতে কোনো ভারতীয় শাড়ি না পরেন; আলমারিতে যে কটা শাড়ি আছে সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব আপনারা সত্যিকারে ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।
ভারত থেকে গরম মসলা, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা আমদানির কথা তুলে এগুলো বিএনপিনেতারা রান্নায় ব্যবহার করবেন কি না, সে প্রশ্নও তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মসলাপাতি, আদা যা কিছু আসছে, তাদের কারও রান্না ঘরে যেন এই ভারতীয় মসলা না দেখা যায়। তাদের রান্না করে খেতে হবে এসব মসলা দিয়ে। কাজেই এটা তারা। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমাদের দেশে কিছু আঁতেল আছেন। বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন যিনি। বাংলাদেশে আমরা দেখি, অতিবাম, অতিডান। স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিক ধারাটা তারা পছন্দ করেন না।’
আরও পড়ুন
অনেকে মনে করেন বিএনপি তাদের রাজনীতিতে নতুন একাধিক উপাদান যোগ করার চেষ্টা করছে। আগে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই ছিল উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো একটি বিষয় নিয়ে লোক দেখানো কিছু সমাবেশ করার চেষ্টা করা। মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ করা এসব ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একটি নতুন বিষয় হয়েছিলো। এখন তারা তাদের কর্মসূচিগুলো শুরু করে লিফলেট আর ফুল বিতরণের মাধ্যমে।
পাকিস্তান ভেঙে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে থাকার দিনতো এখন আর নেই। এখন বাংলাদেশে যদি রাজধানীতে, মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির বহর, তবে সেই বাংলাদেশ তো অনেকের কাম্য নয়। বাংলাদেশকে মনে করা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, এটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে। আত্মমর্যাদা এবং নিজের টাকায় পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনা কেবল বাংলাদেশকে উন্নত এবং অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বাংলাদেশকে একটা আত্মসম্মান মর্যাদায় নিয়ে গেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে যেভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন তার অসম্পূর্ণ স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল চালু করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বেড়েছে। এ সরকারের মেয়াদকালে গত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। এগুলোতো অনেকের পছন্দ নয় তাই জনগণকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে যদি কিছু হয়। কিন্তু জনগণ এখন অনেক সচেতন।
হীরেন পণ্ডিত ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট