ছবি : সংগৃহীত

মাইক্রোপ্লাস্টিক কী?

প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং এর দূষণের মাত্রা সারা বিশ্বেই বেড়ে চলছে। প্লাস্টিকের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যগত বিপদ সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত, কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক মাইক্রোপ্লাস্টিক অনেক বড় হুমকি। এর প্রভাব আরও ভয়াবহ।

মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে শরীরের পক্ষে অত্যন্ত বিষাক্ত প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নন-ডিগ্রেডেব্‌ল কণা। যেসব প্লাস্টিকের আকার ২ মাইক্রোমিটার থেকে ৫ মিলিমিটারের মধ্যে, সেইসব প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। এরা সাধারণত বড় আকারের প্লাস্টিকগুলো থেকে তৈরি হচ্ছে এবং নারডল নামে পরিচিত।

প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ

প্লাস্টিককে বলা হয় ‘নেসেসারি এভিল’। বর্তমানে আমরা যে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সেইখানে আমাদের নিত্যব্যবহার্য অনেককিছুই প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিক একদম সস্তা পণ্য নয়। বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক যে জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে, তা হয়তো বাস্তবতা। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা বদলে দেওয়ার সুযোগ ও সময় এসেছে।

২০১৪ সালের প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ ‘শীর্ষ দশ জরুরি পরিবেশগত সমস্যাগুলো’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পরিবেশ এবং পরিবেশবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ও ওজোন হ্রাসের পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি বড় বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হয়ে ওঠে। আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানে যেমন মাটি, পানি, বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। 

মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের বিস্তার ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশে পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন আকাশে, বাতাসে, পানিতে, খাবারে। এদের দেখা মিলেছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার মিটার উপরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে।

১৯৫০ সাল থেকেই শিল্প খাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৪০ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টন প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। একটি পতিত প্লাস্টিক পচে যেতে ৪০০ বছর সময় লাগে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত

জীববিজ্ঞানী রিচার্ড থম্পসন প্রায় ৩০ বছর আগে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা ক্ষুদ্রপ্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেন। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের আইল অব ম্যান সৈকত পরিষ্কারের সময় রিচার্ড থম্পসন বিভিন্ন রঙের বালুর খোঁজ পান। সেই বালুর রহস্য উন্মোচন করার সময়েই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার সন্ধান পান রিচার্ড থম্পসন।

পরবর্তী ১০ বছর সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে সেই রঙিন বালু নিয়ে গবেষণা করে তিনি বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক কখন যে সমুদ্রসৈকতগুলো দখল করে নিয়েছে, তা মানুষ টেরই পায়নি। শুধু সমুদ্র পরিষ্কার কিংবা বায়োডিগ্রেডেবল (জীবাণু বিয়োজ্য) প্লাস্টিক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী এই সংকটের প্রভাব কমানো যাবে না।’

Microplastics : মাইক্রোপ্লাস্টিক; ছবি : সংগৃহীত

মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের বিস্তার ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশে পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন আকাশে, বাতাসে, পানিতে, খাবারে। এদের দেখা মিলেছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার মিটার উপরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে। এদের দেখা মিলেছে পৃথিবীর গভীরতম প্রশান্ত মহাসাগরের সাত মাইল অতলে, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে আর্কটিক বরফ পর্যন্ত।

এর আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, খাদ্য, পানি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। তা থেকে ধারণা করা হয়, মানুষ সম্ভবত নিয়মিতভাবে এসব কণা গ্রহণ করে।

মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক

মানবশিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য তার মায়ের দুধ। তাও এখন আর নিরাপদ নেই, সেখানেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। তার মানে, যে শিশু আজ ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, সেও কি মায়ের পেট থেকেই প্লাস্টিক সঙ্গে করে নিয়ে আসছে? প্লাস্টিক দূষণ যদি চলতেই থাকে, তাহলে সবার সন্তানই সমান ঝুঁকিতে থাকবে।

এমনকি মানুষের লালা, মল, রক্ত ও প্লাসেন্টাতেও পাওয়া গেছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যাদের রক্তপরীক্ষা করেছেন, তাদের ৮০ শতাংশের মানুষের রক্তেই পেয়েছেন অত্যন্ত বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক। আর তাদের অর্ধেকের রক্তেই পাওয়া গিয়েছে আরও বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক—‘পেট’। এমন মাইক্রোপ্লাস্টিকেরও দেখা মিলেছে মানবরক্তে, যাদের ব্যাস ০.০০০৭ মিলিমিটার (এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের সাত ভাগ মাত্র)।

অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। একজন মানুষের দেহে পানীয় জল ও নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম অর্থাৎ বছরে ২৫০ গ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকছে। সাধারণভাবে একটি ক্রেডিট কার্ডের আকার প্রস্থে ৮৫ দশমিক ৬০ মিলিমিটার ও লম্বায় ৫৩ দশমিক ৯৮ মিলিমিটার হয়।

গবেষকরা বলছেন, এই পরিমাণ প্লাস্টিক প্রতি সপ্তাহে মানুষ কোনো না কোনোভাবে খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করছে। এই বিষ আমাদের দেহের কতভাবে ক্ষতি করতে পারে, তা এখনো গবেষণার বিষয়।

মানুষের সংস্পর্শে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎসগুলো হলো বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী এবং সিনথেটিক পোশাক। সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মানবস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা প্লাস্টিক কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুস হয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে ক্যানসারসহ স্নায়ুজনিত রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ হতে পারে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত নিউক্লিওফিলিক (নিউক্লিয়াস আকর্ষী) ম্যাক্রোমলিকিউলের (ডিএনএ, আরএনএ) সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে ডিএনএ শৃঙ্খল ভেঙে দেয়। ডিএনএ, লিভার, থাইরয়েড গ্রন্থি, ত্বক এবং কিডনি মাইক্রোপ্লাস্টিকের ‘টার্গেট’ অঙ্গ। নারীদের ক্ষেত্রে, স্তন ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।

Microplastics : মাইক্রোপ্লাস্টিক; ছবি : সংগৃহীত

সামুদ্রিক খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সম্ভাব্য মাত্রা বৃদ্ধি মানবস্বাস্থ্যের ওপর হুমকিস্বরূপ। কাঁকড়া, লবস্টার, লবণ এবং মাছের মতো সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহ ও খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। এসব কণা এক ন্যানোমিটারের মতো ক্ষুদ্র হতে পারে। এই অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা এবং এর থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জৈবিক বাধা পেরিয়ে টিস্যুর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সহজেই।

বায়ুমণ্ডলে মাইক্রোপ্লাস্টিক

প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায় ভরে গিয়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে তা ঢুকে পড়ছে অবলীলায়। বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারের একেবারে উপরের স্তরেও পৌঁছে গিয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। ট্রপোস্ফিয়ারের একেবারে উপরের স্তরে পৌঁছে গিয়েছে বলে আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক। কারণ, বাতাসের গতি সেইখানে অনেক বেশি থাকায় প্লাস্টিকের কণাগুলো তা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বহু দূরে। ফলে যেখানে যাওয়ার কথা নয় সেইখানকার বায়ুমণ্ডলেও মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিকের কোটি কোটি কণা।

জল, স্থল, বায়ুমণ্ডল—প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সর্বস্তরে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়ছে মানব ও প্রাণিজগতে।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

মাইক্রোপ্লাস্টিকের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয় এবং নির্মাতা ও ভোক্তা কেউই মাইক্রোপ্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয়। আর তাই মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে এক ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে চলছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, আমাদের দেশে বর্জ্যব্যবস্থাপনা আধুনিক নয়। এই কারণে নদীর মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে চলে যায়। এতে আমাদের নদী ও সমুদ্র উপকূলের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে মাছ, সেই মাছ মানুষ খাচ্ছে। আবার নদী ও সমুদ্রের মাছ-পাখিদের খাদ্যশৃঙ্খলে থাকার কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাখিরাও খাবারের সঙ্গে খাচ্ছে। এতে আমাদের সমুদ্রের মাছের পরিবেশ, ডলফিনসহ সুন্দরবনের পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ দেশি মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এসব মাছ হচ্ছে কালবাউশ, বেলে, টেংরা, কই, রুই, বাটা, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিং, বাইন, টাটকিনি, বাছা, তেলাপিয়া ও কমন কার্প জাতীয় মাছ। এর মধ্যে আবার রায়না, টাটকিনি ও টেংরা মাছের শরীরে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৯৩ শতাংশ প্লাস্টিক বোতলেই রয়েছে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই প্লাস্টিকের পুরোনো বোতলে দিনের পর দিন পানি পান ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ।

কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলবর্তী দ্বীপ কুতুবদিয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় বলা হয়, দক্ষিণ কুতুবদিয়ার প্যানে প্রতি কেজি লবণে ১ হাজার ২৫৩টি এবং উত্তর কুতুবদিয়ায় ১ হাজার ২৬টি কণা ছিল। বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন লবণ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণ করা কঠিন হতে পারে। প্রাথমিকভাবে এটি মানবদেহের হজম এনজাইমকে বাধা দেয়, যা পেটে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে এটি লিভার ও কিডনিকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতেও বাধা দেবে।

Microplastics : মাইক্রোপ্লাস্টিক; ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে। যদিও এখন অবাধে চলছে এর ব্যবহার। বিশ্বে যে পরিমাণ প্লাস্টিক দূষিত হয় তার মধ্যে দুই দশমিক ৪৭ শতাংশই হচ্ছে এখানে। প্লাস্টিক দূষণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, যার মূল কারণ প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা।

প্লাস্টিক বর্জনই যখন সমাধান

দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার অর্ধেকই পুনর্ব্যবহার সম্ভব হয় না। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা আরও বাড়বে। এই বিপন্ন বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতে চারটি মন্ত্র মেনে চলা জরুরি।

প্রথমত, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যাগ পরিত্যাগ করে বিকল্প হিসেবে কাগজ, কাপড় অথবা কম মূল্যের চটের ব্যাগকে জনগণের কাছে সহজলভ্য করতে হবে পাশাপাশি প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক বিকল্প এবং পচনশীল বা বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগ ও পণ্য উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার।

দ্বিতীয়ত, যতদূর সম্ভব প্লাস্টিক কম ব্যবহার করা, ঘরে ঘরে মানুষকে কাচ, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক ও মাটির বাসনকোসন ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে;

তৃতীয়ত, অপেক্ষাকৃত পুরু প্লাস্টিকের থলি ধুয়ে ও শুকিয়ে আবার ব্যবহার করা;

এবং চতুর্থত, প্লাস্টিক-বর্জ্যকে আবার অন্য রূপে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা। ‘বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমার নয়, অন্য কেউ ওই দায় পালন করবে’, এই মানসিক ব্যাধি থেকে আমাদের এবার মুক্ত হতে হবে। 

মানবশিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য তার মায়ের দুধ। তাও এখন আর নিরাপদ নেই, সেখানেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।

প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও এর ব্যবহার হ্রাস এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিক দূষণ সংক্রান্ত বিধিমালা অবিলম্বে প্রণয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করতে হবে।

প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও নিরাপদ স্থানে ফেলার দায়িত্ব গ্রহণ এবং পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সমসাময়িক ফ্যাশনের ওপর সতর্ক দৃষ্টি আরোপ জরুরি। ফ্যাশন মার্কেটে পলিয়েস্টারের অত্যধিক চাহিদার ফলে বিশ্বজুড়ে পলিয়েস্টারের উৎপাদন ত্বরান্বিত হচ্ছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার বন্ধ হলে, প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে জনস্বাস্থ্য ও ধরিত্রীকে রক্ষা করা যাবে।

যেহেতু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে খুবই অল্প গবেষণা হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। যে প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের ধারক, তাতেই দিনের পর দিন আমরা যেভাবে ছিদ্র তৈরি করে চলেছি, তা বিরাট গহ্বরে পরিণত হতে আর দেরি নেই। নিজেদের এখনো নিয়ন্ত্রণ না করলে সেই কালের গহ্বরেই হারিয়ে যাবে গোটা সভ্যতা। আর একটা সভ্যতা-বধে সফল হবে কয়েক মাইক্রনের প্লাস্টিক।

বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক যে জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে, তা বাস্তবতা। কোম্পানিগুলো যদি প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক এবং পচনশীল বিকল্প উৎপাদন শুরু করে, তাহলে তা অনেক বেশি জনপ্রিয় হবে। এভাবেই আমরা প্লাস্টিকমুক্ত দেশ ও পৃথিবী চাই।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu