উগ্রবাদী দল এবং বাস্তবতা
“রাজনীতিতে যারা ধর্মের ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলতে পারে না।” ১৯৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন হতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলার যে চারা রোপণ করেছিলেন একটি সদ্য ভূমিষ্ঠ দেশে, সেই চারা ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারীরা সমূলে তুলে ফেলেছিল ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশের যাত্রায় যে দলটির হাত ধরে দেশ হাঁটা শুরু করার কথা ছিল সেই দলটিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। আর তার বিপরীতে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল ধর্মান্ধ দলগুলো। ধর্মান্ধ মতবাদ জেঁকে বসেছিল দেশের নীতিতে। যার ফল এখনো দেশকে ভোগ করতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
১৯৯৪ সালে ২৩ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মূলত জঞ্জাল পরিষ্কার করতে শুরু করে। ১৯৯৬-২০০১ এই ৫ বছর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেষ্টা করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম অবক্ষয় হয়েছিল ২৩ বছরে।
আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার ধর্মের উত্থান দেখছি, তার শুরুটা কয়েক বছরের নয়। এই দানব তৈরি করা হচ্ছিল ১৯৭৫ এরপর থেকেই।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে যারা দেশটাকে চালিয়েছে তারা নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতেই বারবার ধর্মান্ধদের ব্যবহার করেছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বারস্থ হয়েছে, এমনকি সংবিধান পরিবর্তন করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মজাটা হলো—এই অস্ত্র থাকলে মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কোনো কাজ করতে হয় না।
ধর্মান্ধ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করলেই সফল হওয়া যায়। তাই সামরিক শাসকরা তাদের গদি টিকিয়ে রাখতে সহজ পথ, অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আশ্রয় নেয়। এছাড়া তারা নিজেরাও সাম্প্রদায়িক, হীন মানসিকতার লোক ছিল বলেই ধর্মকে পুঁজি করে ক্ষমতার খেলা খেলেছে। কিন্তু তাদের এসব নোংরা খেলায় বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
রাজনীতিতে যারা ধর্মের ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলতে পারে না।
যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানের কু-আদর্শ থেকে মুক্তি পেলাম, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এই সামরিক শাসকরা আমাদের সেই কু-আদর্শেরই অনুসারী বানিয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে হয়তো কখনোই এই গোষ্ঠী এককভাবে সুবিধা করে উঠতে পারেনি, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে সময়ের সাথে সাথেই।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের আগমন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরুর মাধ্যমে আমরা একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম যে, আবারও বঙ্গবন্ধুর রোপণ করা ধর্মনিরপেক্ষতার চারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশে বেড়ে উঠবে।
নানাবিধ বাধা-চাপ পেরিয়ে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে নেত্রী অটল থাকলেন, শাহবাগের গণজাগরণ যখন আমাদের অনেক বেশি আশাবাদী করে ফেলেছিল ঠিক তখনই তার বিপরীতে ধর্মান্ধদের জোট পাকাতে দেখলাম। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখলাম, হেফাজতে ইসলাম নামের একটি আঞ্চলিক দলের উদ্ভব। যে দলটি মাঠে নেমেছিল নারী নীতি বাস্তবায়নে বাধা দিতে।
পরে আস্তে আস্তে তাদের চাহিদা আরও বাড়তে থাকে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেয়। দুঃখের বিষয় হলো-এই হেফাজতে ইসলামের অন্যায় দাবি-দাওয়ার পক্ষে তখন সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে যায় সেই সামরিক শাসকদের দুই দল-জাতীয় পার্টি ও বিএনপি।
এমন অবস্থায় হেফাজতের মতো একটি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আর সেই সুযোগ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প নব উদ্যমে ছড়াতে থাকে। এই কয়েক বছরে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, মফস্বলে যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম-তার কুফল আগামী প্রজন্মই মূলত ভোগ করবে।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখলাম, হেফাজতে ইসলাম নামের একটি আঞ্চলিক দলের উদ্ভব। যে দলটি মাঠে নেমেছিল নারী নীতি বাস্তবায়নে বাধা দিতে। পরে আস্তে আস্তে তাদের চাহিদা আরও বাড়তে থাকে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই এসব উগ্রবাদী দলগুলোর শক্তির ভুল হিসাব করে। কারণ এদের সমর্থন নিয়ে পাকিস্তান টিকতে পারেনি। কট্টর ডানপন্থী ধর্ম ব্যবসায়ী এসব দলের সমর্থন ছাড়া বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে সফল হয়েছেন। তার রাজনৈতিক সংগ্রামে এসব দলের হুমকি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যারা এদের সহায়তা নিয়েছেন তারা সাময়িক ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া ছাড়া দেশের জন্য কী করতে পেরেছেন সেটা ভেবে দেখা দরকার।
ধর্মপ্রাণ এদেশের মানুষ। তারা নিজ ধর্ম পালন করার মধ্যেই সন্তুষ্ট। অন্যের ধর্ম নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি নেই। এদেশে উগ্রদের আস্ফালন যতই হোক তাতে জনসাধারণের কোনো সমর্থন থাকে না।
ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি এতই জনসমর্থন পায় তাহলে কোনো নির্বাচনে জয় পেয়ে দেখায় না কেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনোই তারা আলাদাভাবে ৭/৮ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি।
সুতরাং আমাদের বুঝতে হবে, কাদের আমরা বড় করে দেখছি। দেশের মানুষ যাদের সঙ্গে নেই তাদের রাজনৈতিকভাবে বড় শক্তি মনে করার কোনো কারণ নেই। তাদের রাজনৈতিকভাবে ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের উচিত, ইতিহাস থেকে শেখা।
ধর্মব্যবসায়ী দলের কোনো জনসমর্থন এদেশে নেই। যারা তাদের সাথে জোট করেছে- সাময়িক লাভ হলেও চূড়ান্ত বিচারে জনগণ তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ঠিক যেমন সামরিক শাসকদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
সিলভিয়া পারভিন লেনি ।। সদস্য, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ