আরেক টাইম বোমা বিস্ফোরণের অপেক্ষায়!
১২ মার্চ ২০২৪ রাত ২টা ১০ মিনিটের দিকে রাজধানী উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ারের পাশের কাঁচাবাজারে আগুন লাগে। তার কয়েকদিন আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ আগুন লেগেছিল বেইলি রোডে। সেই আগুনে ৪৬ জন মারা যান।
বেইলি রোডের আগুনের ঘটনার শোক আমরা ভুলতে বসছি। ১ মার্চ ২০২৪ থেকে যেভাবে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছিল তার উত্তাপ এখন কমছে। এটাও জানি, এই উত্তাপ একেবারে কমে অভিযান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
বিজ্ঞাপন
তবে এমন বড় অভিযান আবার শুরু হবে এই ভবিষ্যৎ বাণীও অবলীলায় বলে দেওয়া যায়! যেহেতু ঢাকার অনেক ভবন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে তাই বলা যায়, ভবিষ্যতে আবার কোথাও না কোথাও এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে। আবার এমন অভিযান শুরু হবে। তারপর আবার বন্ধ। আবার শুরু। এসব ভবিষ্যৎ বাণীর জন্য জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না!
অতীতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার পরপরই ঠিক এমন অভিযান হয়েছে। আবার এসব তথাকথিত অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব অভিযান লোক দেখানো কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কম ঘটেনি। পৃথিবীতে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গড়ে দিনে ৭৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব আগুনের মধ্যে সর্বোচ্চ বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। এর পরই বিড়ি সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
এক বছরে অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে আগুনের ঘটনায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
এক বছরে ২৭ হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও গণমাধ্যমে সব তথ্য আসেনি। অর্থাৎ অগ্নিকাণ্ডে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে তা নজরে আসছে। এর বাইরে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আগুন লাগছে।
পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার থেকে বঙ্গবাজার, পনের বছরে ঢাকা এবং এর আশেপাশে অনেকগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবকটির ক্ষেত্রেই সম্মিলিত গাফিলতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য দেশে হলেও বাংলাদেশে প্রাণহানি হয় বেশি। এর কারণগুলো স্পষ্ট। দেশের বেশিরভাগ ভবনে জরুরি অবতরণে সিঁড়ির রাস্তা প্রশস্ত নয়। আগুন লাগলে তা দিয়ে বের হওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। অনেক বহুতল ভবনে একাধিক সিঁড়িও নেই। যেভাবে রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে সবকিছু গড়ে উঠেছে সেইখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তা নির্বাপণ করাই কঠিন।
বাংলাদেশে এখন অনেক আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক ভবনেও হচ্ছে রেস্টুরেন্ট। যেসব শপিং মল বা বাণিজ্যিক ভবনে রেস্টুরেন্ট হয়েছে সেই ভবনের ডিজাইন এবং অনুমোদন মূলত অফিস বা অন্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য দেওয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টের জন্য দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন
অথচ ঢাকার বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনে দিব্যি গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। যাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস এবং আগুনের ব্যবহার হচ্ছে। কিছু ভবনের ছাদেও গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। তদারকি না থাকায়, যে যেভাবে পারছে সেইখানে রেস্টুরেন্ট দিচ্ছেন।
বেইলি রোডের ঘটনায় আবার প্রাসঙ্গিকক্রমে ফিরি। সেইখানে গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনটিতে যে আগুনের ঝুঁকি ছিল, তা জানতো সরকারি সংস্থা। গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, তিনবার চিঠি দেওয়ার পরও তা আমলে নেননি ভবন মালিক। বাণিজ্যিক ও আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে সেইখানে রেস্টুরেন্ট বা পণ্য বিক্রি করা হয়।
ভবনটিতে একটি সিঁড়ি থাকলেও ছিল না অগ্নিনির্গমন পথ। সংকীর্ণ সেই সিঁড়িতেও ছিল গ্যাস সিলিন্ডারসহ নানা প্রতিবন্ধকতা। কাচঘেরা ভবনটিতে বাতাস ও ধোঁয়া বের হওয়ারও কোনো পথ ছিল না। আর ছাদেও রেস্তোরাঁ থাকায় সেইখানেও ফাঁকা জায়গা ছিল সামান্য। ভবনে রেস্টুরেন্ট আছে রাজধানীর অনেক ভবনের অবস্থাই গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনটির মতোই।
রাজধানীর বাণিজ্যিক ভবনগুলোর বিভিন্ন তলায় যেভাবে রেস্টুরেন্ট তৈরি করা হয়েছে, তাতে মূলত ভবনগুলো ‘টাইম বোমা’য় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন একজন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি।
রেস্টুরেন্ট ব্যবসা অবৈধ নয়। এই ব্যবসার সঙ্গে অনেকের রুটি রুজি জড়িত। কিন্তু এই ব্যবসাটি কোথায় করা হলে মানুষের জীবন নিরাপদ থাকবে সেই বিষয়টির দিকে জোর দেওয়া উচিত।
বছরের পর বছর ধরে ধানমন্ডি, বেইলি রোড, সাতমসজিদ রোড, পল্টন, গুলশান, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। গণপূর্ত, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর—সবার চোখের সামনেই এসব গড়ে উঠেছে। প্রশ্ন হলো, এগুলোর অনুমোদন কে দিয়েছে?
পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার থেকে বঙ্গবাজার, পনের বছরে ঢাকা এবং এর আশেপাশে অনেকগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবকটির ক্ষেত্রেই সম্মিলিত গাফিলতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন কি হয়েছে? হলেও তা যৎ সামান্যই।
একটি ভবন কীভাবে গড়ে ওঠে? গণপূর্ত, গৃহায়ন কিংবা রাজউকের মতো সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্মিত হয় ভবন। অনুমোদনের পর ভবন ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে কি না তার দায় রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনের। অনুমোদনের নথিতে লেখা হলো ভবনে অফিস হবে; পরে দেখা গেলো ওই বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। তার মানে তদারককারীরা পরে আর তদারকি করবে না? কেবল অনুমোদনেই শেষ?
আরও পড়ুন
রেস্টুরেন্ট ব্যবসা অবৈধ নয়। এই ব্যবসার সঙ্গে অনেকের রুটি রুজি জড়িত। কিন্তু এই ব্যবসাটি কোথায় করা হলে মানুষের জীবন নিরাপদ থাকবে সেই বিষয়টির দিকে জোর দেওয়া উচিত।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তা কেবল অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কয়েকদিন অভিযান, এরপর আর টনক না নড়লে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।
দেশের মানুষকে অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচাতে অভিযানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। জোরালোভাবে এটা অব্যাহত রাখার বিকল্প আর কিছুই নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী টেকসই ব্যবস্থা নেওয়াই পারে আমাদের জীবন এবং সম্পদকে আগুন থেকে বাঁচাতে। যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব তদারকি না করা হয় তাহলে আরেকটি টাইম বোমা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ