স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধ হবে কবে?
করোনার মহামারিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও বিপর্যস্ত। করোনা ঊর্ধ্বগতি, নিম্নগতি দেখা গেলেও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সবসময় ‘পিক’ই থেকে গেছে। টেস্টের অভাবে যেমন করোনা শনাক্ত হয় না, একইভাবে স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি হয়তো করোনা না আসলে শনাক্তের বাইরেই থেকে যেত । প্রশ্ন হচ্ছে, এখন যা দেখছি এটা কি আসলেই নতুন না কি আমরা নতুন করে জানলাম অথবা যা আগেই জানতাম এখন সে ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হলাম।
বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তা আজ খোদ বিরোধীরাও স্বীকার করছে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলেও দুর্নীতির ব্যাপকতা কমেনি বরঞ্চ নতুন নতুন দুর্নীতির খাত তৈরি হয়েছে। যেমন করোনাকালে পিপিই, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনাসহ নানান ধরনের বহুমুখী দুর্নীতির দেখা মিলেছে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন দুর্নীতির এ ব্যাপকতা কি শুধু স্বাস্থ্য খাতেই? আসলে হয়তো সব খাতেই এর চেয়ে বেশি বা কম দুর্নীতি হয়, কিন্তু স্বাস্থ্য খাত অন্যান্য খাত থেকে অনেকটাই আলাদা। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সরাসরি মানুষকে প্রভাবিত করে, জন্ম-মৃত্যুকে প্রভাবিত করে আর তাই হয়তো এই খাতের দুর্নীতি আমাদের অনেক বেশি বেদনা দেয়।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সরাসরি মানুষকে প্রভাবিত করে, জন্ম-মৃত্যুকে প্রভাবিত করে আর তাই হয়তো এই খাতের দুর্নীতি আমাদের অনেক বেশি বেদনা দেয়। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি করোনা মহামারির মতো জেঁকে বসেছে।
করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি করোনা মহামারির মতো জেঁকে বসেছে। করোনার ঊর্ধ্বগতিতে হাসপাতালে শয্যা ও আইসিইউ’র জন্য কত হাহাকার। কত মানুষ হারাচ্ছে তাদের প্রিয়জনদের। একটু অক্সিজেন প্রাপ্তি তা বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারতো। গতবার সময় পায়নি সে অজুহাত মানা গেলেও এবার তা মানা অনেক কষ্টকর। দুর্নীতি আর দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই সঙ্কট যে আরও ভয়াবহ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনাকালে দুর্নীতির এই স্বরূপ দেখলে কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন দুর্নীতির বেশির ভাগই হয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা মেনে ক্রয় করা হয় না বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয় বা অধিক মূল্যে জিনিস কেনা হয়। যেমন গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পিপিই-মাস্কসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অন্তত ৭২১ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। (বণিক বার্তা, ১৮ এপ্রিল, ২০২১)। এরকম আরও দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলার খবর আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি। যেমন করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থ সময় সু্যোগমতো ব্যবহার করতে না পারা।
দুর্নীতির বেশিরভাগই যেমন হয় কেনাকাটায়, এই দুর্নীতি প্রকাশ পেলে সরকারের প্রতিক্রিয়াটা আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম হয়ে থাকে, আর সেটা হলো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বদলি করে দেওয়া, যা অনেক সময় পুরস্কারের মতো মনে হয়। এই ধরনের আচরণ দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করে। তাছাড়া অতীত দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে বরাবর একই উত্তর পাওয়া যায়—আমি নতুন তাই আমি কিছু জানি না। আর পুরনো লোক বলবে আমি তো আর সে পদে নাই, তাই আমি কিছু বলতে পারবো না। কি চমৎকার সমাধান!
তাছাড়া তাদের কোনো জবাবদিহিতায় আনা হয় না। মানুষের কাছে কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় এর স্বরূপ অনেক সময় উন্মোচন করা যায় না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) দুর্নীতির কথা বলা হলেও রহস্যজনক ভাবে যে সরবারহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এতে এটা মনে হতেই পারে সে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর একটা প্রয়াস রয়েছে।
দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা না করলে দুর্নীতির এই যজ্ঞ সহজে কমবে না। দুর্নীতি করলে আর দায়িত্বে অবহেলা করলে তাদের শুধু বদলি না করে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে আর অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেলেও অতীত কার্যক্রমের জন্য দায়বদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে বরখাস্ত ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
দুর্নীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের একটা সুপারিশ থাকে তা হলো, তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। স্বচ্ছতার স্বার্থে সব তথ্য সহজলভ্য করতে হবে। সরকার কোন যন্ত্রপাতির জন্য কত ব্যয় করেছে, কোন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ দিয়েছে, যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশনসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকলে দুর্নীতি হয়েছে কি না তা সহজে বোঝা যাবে। এতে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
দুর্নীতি সব দেশেই হয়, কিন্তু কিছু দুর্নীতি রাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি বিব্রতকর। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি শুধু মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলেনি, দুর্নীতির প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের কোমল ও সহনশীল মনোভাব মানসিক যাতনা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মৃত্যুর এই মিছিলে একদল ব্যস্ত আছে আরও ধনী হওয়ার মোহে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ও তথ্য প্রবাহ অবাধ করা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল ।। সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়