ছবি : সংগৃহীত

গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৩৪ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৭০ পয়সা বাড়বে। বিদ্যুতের নতুন এই দর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (ঢাকা পোস্ট, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার সরাসরি জনগণের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের গালগপ্পো এতদিন ধরে জনগণ শুনে আসছে। একই সাথে এটাও শুনে আসছে যে এই খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির নামে জনগণের টাকা কোনো কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কমিশন ভোগীরা তো আছেই।

স্বল্পমূল্যে নিরবচ্ছিন্ন লোডশেডিং মুক্ত বিদ্যুতের দাবি দীর্ঘদিনের। আমাদের সংবিধানেও বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অধিকারের কথা বলা আছে। অতীতের সরকার এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে এটা ঠিক।

বাস্তবতা হলো এর আগের সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করে খাম্বা তৈরি করেছিল। এর জন্যে বিদ্যুৎ না পেয়েও জনগণের টাকা গুনতে হয়েছিল। আর এবার সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলেও এইসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যথাযথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না, করতে পারছে না। বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও জনগণের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।

আমরা এবং দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম যে, দেশের মানুষের বাস্তবতা বিবেচনা করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ স্বল্প মূল্যে দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক অবস্থান থেকে পরিকল্পনা করেই এগোতে হবে। এজন্য আমরা আমাদের দেশের গ্যাস সম্পদের ওপর নির্ভর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভর করেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেছিলাম। 

ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকলে প্রতি মাসে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়বে তাই নয়। বিদ্যুতের সাথে জড়িত পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সবকিছুরই উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।

এমনকি এই বিষয়ে আমাদের খসড়া প্রস্তাবনা আমরা হাজির করেছিলাম। সরকার সেই দিকে কর্ণপাত করেনি। বরং এক্ষেত্রে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো করা হয়েছে। যা বিদ্যুৎক্ষেত্রে দায়মুক্তি আইন বলে পরিচিতি পেয়েছে।

দেশের গ্যাস সম্পদ ব্যবহারের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারেও পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং আমদানির ওপর নির্ভর করা হয়েছে।

আমরা সাধারণ ভাষায় বলেছিলাম, সরকারের এই ভুলনীতি এবং বিশেষ আইন জারি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে যে দুর্নীতি তৈরি হচ্ছে তা ভবিষ্যতে জনগণকে ভোগাবে। ওই সময় আমাদের এটাও শোনানো হয়েছিল যে এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, পরে দাম কমবে।

সর্বশেষ কী খবর পেলাম? সরকার পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলো তারা এইক্ষেত্রে আর এক টাকাও ভর্তুকি রাখবে না। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে এখন যে দামে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে তা প্রকারান্তরে দ্বিগুণ করে ফেলা হবে। এর জন্য অবশ্য সরকার একটু সময় নিচ্ছে। এভাবে দাম বাড়তেই থাকবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে পুরো বৃদ্ধি তারা সম্পন্ন করবে। এই হলো এখনকার পথ নকশা।

মূল্যবৃদ্ধি শব্দটা শুনলেই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এজন্য সরকার নতুন শব্দ চয়ন করছে, তা হলো তারা মূল্যবৃদ্ধি করছে না, করছে উৎপাদন মূল্যের সমন্বয়।

আমরা পরিষ্কার বলেছি, এই যে উৎপাদন মূল্যের কথা বলছেন—এই উৎপাদন মূল্য অযৌক্তিক। যা আমরা গণশুনানিতে একাধিকবার প্রমাণ করেছিলাম। সরকার তো এখন গণশুনানি বন্ধই করে দিয়েছে। গণশুনানিতে আমাদের দাবি না মানলেও বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচারের কারণে আমাদের যৌক্তিক বক্তব্য দেশবাসী জানতে পারতেন। তাই যে উৎপাদন মূল্য দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে এর দায় দেশের মানুষ মেনে নেবে না।

সরকারি তথ্যই বলছে, দেশের সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতিতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় অনেকে খাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য কার্যক্রম কমিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য অনেকে গ্রহণ করতে পারছে না।

এরপর ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকলে প্রতি মাসে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়বে তাই নয়। বিদ্যুতের সাথে জড়িত পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সবকিছুরই উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এসব পণ্যের দামও বাড়বে। আর এই দাম বৃদ্ধি করে জনগণের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। অর্থাৎ জনগণকে আগামী দিনে প্রতিদিনই দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ইতিমধ্যে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ও নিয়মিত গ্যাস বিদ্যুৎ না পাওয়ায় অনেক ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হবে। অতীতে এই ধরনের উদ্বেগকেও সরকার কানে নেয়নি।

ব্যবসায়ীরা হয়তো দেন দরবার করে, ব্যাংক লোন নিয়ে নানাভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবেন। কিন্তু সাধারণ জনগণ কী করবে? তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে নিজের পকেট উজাড় করে দেওয়ার জন্য। আর পকেটে কিছু না থাকলে বিদ্যুৎ গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া এবং খাওয়া কমিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।

এবারের গল্প এখানে শেষ নয়। আমরা সরকারের কাছ থেকে শুনতে পেলাম আগামী গরমের সময় লোডশেডিং এর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তার মানে শুধু বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই সরকার ক্ষান্ত হচ্ছে না। সরকার যে, সব মানুষকে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিতে পারবে না, তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা হচ্ছে। 

বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করার নামে যে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বাড়ানো হলো তার জন্য দায়ী কারা? যে ভুলনীতির কারণে আজ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কবে?

আমরা সরকারের কাছে জানতে চাইবো, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করার নামে যে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বাড়ানো হলো তার জন্য দায়ী কারা? যে ভুলনীতির কারণে আজ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কবে?

একইসাথে মূল্যবৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ জনগণের কাঁধে আরও মূল্যবৃদ্ধির বোঝা না চাপিয়ে, উৎপাদন ব্যয় কমানোর ও যথাযথভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

‘টাকা নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে’—এই ধরনের খবর কেউ কেউ বলতে চাইছেন। আমরা এটি মানতে নারাজ। দেশের টাকা বিদেশে অবাধে পাচার হয়ে গেছে, যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ হয়নি। অপ্রয়োজনীয় বৃহৎ প্রকল্প বন্ধ করা হয়নি। সরকার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা নেয়নি।

জনস্বার্থে তাই এখনই এসব টাকা উদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা নেওয়া হোক। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করা হোক। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতকে যৌক্তিকভাবে পরিচালনার জন্য দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হোক।

এসব কাজ না করে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ এর কথা শুনে, তাদের দেওয়া শর্ত পূরণ করতে ও যারা দেশকে আমদানি জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে চায় তাদের ও কমিশনভোগীদের স্বার্থ রক্ষায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির লাগাতার পদক্ষেপ অব্যাহত রাখলে তার বিরুদ্ধে জনগণকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
hossainprince@yahoo.com