দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কি সফল হবে?
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন রাজধানীতে ঘুরছি এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে। ভোটের মাঠে নেই ভিড়-ভাট্টা। নেই সংঘাত-সহিংসতাও। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার মতো সংবাদকর্মীদেরও সতর্ক থাকা ছাড়া তেমন কায়িক শ্রম নেই।
নিরুত্তাপ দিনটিতে দুপুরে পুরান ঢাকার একটি কেন্দ্রের সামনে এসে থামে অফিসের গাড়ি। পাশে আরও কয়েকটি চ্যানেলের বাহন। আমরা সংবাদকর্মীরা নিজেদের মধ্যে যখন আলাপ-আলোচনা করছি তখন ষাটোর্ধ এক লোক ডান হাত একটু উপরে তুলে কাছে আসেন। বলেন, ‘আমি একজন রিকশাচালক। কিছু বলতে চাই।’
বিজ্ঞাপন
ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করা একজন সহকর্মী তখন বলেন, ‘হ্যাঁ চাচা বলেন...’। এরপর ওই রিকশাচালক জানান, নির্বাচনে যতবার ভোট দিয়েছেন নৌকা ছাড়া দেননি। হাত সামনে রেখে আঙুলে কালো মার্কারি চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখেন চিহ্ন...’
আরও পড়ুন
এই সময়ে আমাদের একজন সাংবাদিক কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এসব আমাদের বলছেন কেন? ভোট আপনি যাকে খুশি দেন।’ এরপর ওই রিকশাচালক কিছুটা চড়া গলায় বললেন, ‘বাপ চাচারা শেখের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) রাজনীতি করতেন তাই নৌকা ছাড়া কাউরে ভোট দিতে পারি না, আইজও দিলাম কিন্তু গত কয়েক বছরে পেটে মাছ-মাংস খুব কম গেছে...’। বললেন, ‘পাঁচ-ছয় বছর আগেও ব্যাগ ভরে বাজার করলেও এখন ঠোঙ্গা হয়...’।
আওয়ামী লীগের আখড়া হিসেবে পরিচিত ওই এলাকায় আপন মনে কথা বলতে লাগলেন ওই রিকশাচালক। চাল, ডাল, নুন, সবজির দাম নিয়েও গলা ঝাড়লেন। গলার স্বর কিছুটা উঁচু হওয়ায় আশেপাশের কয়েকজনও ওই রিকশাচালকের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।
ক্ষমতার রাজনীতিতে যুক্ত নয় দেশের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ির সুবিধা চায় না। উল্লেখযোগ্য মানুষ চায়, খেয়ে-পরে একটু শান্তিতে থাকতে। কিন্তু তা কি পারছে?
কেউ হাসেন। কেউ আগ্রহ নিয়ে শোনেন। অদূরে থাকা এক ইউটিউবারের কানেও যায় এই স্বর। ছুটে এসে মোবাইল ক্যামেরা বের করে বলেন, ‘চাচা আপনার কথাগুলো আবার বলেন’। কিছুটা বিরক্ত হয়ে পরে ওই রিকশাচালক নিজের মতো করে মোবাইলের সামনে দ্রব্যমূল্য নিয়ে ক্ষোভ ঝারতে থাকেন।
লেখার শুরুতে এই ঘটনা টেনে আনার কারণ ওই রিকশাচালক ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ একজন কর্মী। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় যার চোখে মুখে ছিল ক্ষোভের আগুন। দ্রব্যমূল্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের সাধারণ মানুষেরও কমবেশি এমন প্রতিক্রিয়া থাকবে।
আরও পড়ুন
ক্ষমতার রাজনীতিতে যুক্ত নয় দেশের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ির সুবিধা চায় না। উল্লেখযোগ্য মানুষ চায়, খেয়ে-পরে একটু শান্তিতে থাকতে। কিন্তু তা কি পারছে? বাজারে যে আগুন লেগেছে সেই আগুনে যেন পুড়ে মরছে নিরীহ সাধারণ মানুষ!
আমাদের দায়িত্বশীল লোকজন প্রায়শই বাজার পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকে দায়ী করেন। এই যুদ্ধের শুরু থেকে এখনো তারা গেয়েই যাচ্ছেন একই গান। এটা ঠিক যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং ডলার সংকটের কারণে বিভিন্ন দেশে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
যুদ্ধের প্রভাবে বিভিন্ন দেশে কিছু জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের দেশে গোটা বাজারেই যেন প্রভাব পড়েছে। আলু-পটল আর কাঁচা মরিচের দামও যে হারে বেড়েছে তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং গরিব মানুষেরা আমিষের ঘাটতি মেটাতে সাদা ব্রয়লার মুরগি খেতেন। সেই ব্রয়লার মুরগির দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। সব মিলিয়ে পুরো বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাজার জুড়ে যেন অরাজক পরিস্থিতি! খেতে হবে, তাই মানুষও জিম্মি এই পরিস্থিতির কাছে।
জিনিসপত্রের যে দাম তাতে গরিব, নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তরা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে! দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রীর বদল হয়েছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থার কি উন্নতি হয়েছে?
টানা চারবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। প্রতিবার নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল হয়েছে। পদ্মা নদীর ওপর সেতু হয়েছে। পারমাণবিক যুগে গেছে বাংলাদেশ। এত এত উন্নয়ন শুধু মানুষের আরামের জন্যই। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক খাওয়া। উল্লেখযোগ্য মানুষ তার পছন্দ অনুযায়ী খাবার কিনতে পারছে না অতিমূল্যের কারণে।
দশ-বিশ বছর আগের চেয়ে মানুষের আয় কিছুটা বাড়লেও তার চেয়ে বহুগুণ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যয়। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে গরিব, নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তরা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে! দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রীর বদল হয়েছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থার কি উন্নতি হয়েছে?
আরও পড়ুন
জিনিসপত্রের দাম কীভাবে বাড়ে তা নিয়ে অনেক গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাজধানীতে উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা গাড়িগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে কিছু অসাধু ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে পণ্যের পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যায়। এরপর ওই পণ্য ঢাকায় আসার পর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে। এভাবে পণ্যের দাম মাঠে কেনা দামের চেয়ে বহুগুণে কিনতে হয় ক্রেতাদের।
আন্তর্জাতিকভাবে কিছু পণ্যের দাম কমে-বাড়ে এটা মোটামুটি সবার জানা। কিন্তু যে পণ্যগুলো নিজেদের উৎপাদিত, তা চাঁদাবাজি এবং মাফিয়া ব্যবসায়ীদের কারণে দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে এটা মানা যায় না। এসব নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
শুধুমাত্র সরকারি অভিযানে জিনিসপত্রের দাম কমবে না। গোঁড়ায় হাত দিতে হবে। ঢাকায় ঢুকতে সবজির ট্রাক থেকে কারা টাকা নেয়, এই টাকার ভাগ কারা পায় তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।
এরপর সিন্ডিকেটে জড়িত হোতাদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই স্বাভাবিক থাকবে অনেক পণ্যের মূল্য। স্বস্তিতে থাকবে মানুষ। কিন্তু এই স্বস্তি কবে পাবে মানুষ?
আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ