ছবি : সংগৃহীত

স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা এবং বিশৃঙ্খলাজনিত মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব ক্রমেই বাড়ছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এর পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যসেবার মতো জীবন ঘনিষ্ঠ এবং মৌলিক বিষয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে এবং গুণগত মানোন্নয়নে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। সুন্নাতে খৎনা করতে গিয়ে বারবার শিশু মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দীর্ঘদিনের হেলাফেলা, অবহেলা এবং ভুল নীতির ফলে সৃষ্ট তিক্ত এবং বিষাক্ত ফল। তবে এর বহিঃপ্রকাশের শুরু মাত্র।

দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা এবং বিশৃঙ্খলার ফলে স্বাস্থ্যখাতের ক্ষত এতটাই গভীর এবং দগদগে, যা কোনো মলমে সারার উপযোগ্য নয়। সমস্যা এখন হিমালয় পর্বতসম। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জাতি এখনও আঁচ করতে পারছে না। 

তবে কেন এই বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থাপনা? এটা নিশ্চয়ই আমাদের অর্থ সংকটের জন্য নয়। এ দেশের মানুষ প্রতিবছর এক লাখ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্যসেবার জন্য খরচ  করে। আর সরকার খরচ করছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে উন্নত বিশ্বের মতো সেবা দেওয়া সম্ভব।

বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থাপনার প্রধান কারণ হলো আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যখাত এবং এই খাতের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিখাদ এবং সামগ্রিক ধারণার অভাব। স্বাস্থ্যখাতের অবয়ব, কলেবর, কাঠামোগত জটিলতা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতাসহ বহুমুখী বৈশিষ্ট্য আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের নিকট সমন্বিতভাবে বোধগম্য নয়। তাদের চিন্তা-চেতনা হাতুড়ের মতো। ফলে, তারা স্বাস্থ্যখাতকে অন্যান্য খাত থেকে আলাদা হিসেবে ভাবতে পারেন না। তারা ভাবতে পারেন না যে মেডিকেল শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার মতো নয়। মেডিকেল শিক্ষাকে তারা মাধ্যমিক শিক্ষার মত মনে করে। 

উল্লেখ্য, সাধারণ শিক্ষার একজন শিক্ষার্থী যদি কিছু না শিখে পাস করে তাতে জাতির তেমন ক্ষতি হয় না। তবে মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে এরূপ হলে তার হাতে জাতি কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। যেনতেনভাবে জোড়াতালি দিয়ে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা যে জাতির জন্য কতটা আত্মঘাতী তা তাদের ধারণায় নেই। তাই তারা সরকারি ও বেসরকারি খাতে যত্রতত্র  মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছে। সেখানে উপযুক্ত শিক্ষক, ইন্টার্নশিপের জন্য হাসপাতাল, থাকার জন্য হোস্টেল কিংবা লেখাপড়ার পরিবেশ কোনোটাই নেই। গত প্রায় দুই যুগ ধরে গড়ে ওঠা এসব হাতুড়ে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক প্রকার হাতুড়ে চিকিৎসক তৈরি করছে। আর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতোত গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক কেন্দ্র ও হাসপাতাল মালিকদের অতি মুনাফা লোভীতার বদৌলতে এই হাতুড়ে চিকিৎসকরা আজ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দেশ ও জাতি আজ হাতুড়ে চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত, হাতুড়ে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা আধুনিক হাতুড়ে চিকিৎসকদের কবলে।

অন্যদিকে, সারা দেশের লাখ লাখ প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক কেন্দ্র ও হাসপাতাল সুপারভিশন এবং মনিটরিং করার জন্য যুগোপযোগী কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারিনি। সম্বল এখনও ১৯৮২ সালের অর্ডিন্যান্স, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারেই সেকালে। কোনো উপযুক্ত সুপারভিশন এবং মনিটরিং কাঠামোও গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটছে। এই ঘোড়ার ঘুরের আগাতেই আমাদের সন্তানরা সুন্নাতে খৎনা করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে।

মোদ্দাকথায়, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। রোগীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পদ্ধতির মধ্যে মূলত রয়েছে রোগীর নিরাপত্তার প্রতি ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা এবং এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করা যেখানে রোগীর নিরাপত্তাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়; স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং পদ্ধতি এবং ক্লিনিক্যাল প্রক্রিয়াগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও পরিচর্যা কর্মীদের দক্ষতা তৈরি করা এবং টিমওয়ার্ক ও পারস্পরিক যোগাযোগ উন্নতি করা। রোগীর নিরাপত্তা বিধানে এই পদ্ধতিগুলো সারা বিশ্বে অনুসরণ করা হলেও বাংলাদেশে তেমন অনুসরণ করা হয় না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। এখনই দায়ী ফ্যাক্টরগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা বন্ধ করতে না পারলে এ জাতির পতন অনিবার্য।

এজন্য ল্যাব নেই, শিক্ষক নেই, হাসপাতাল নেই; এসব সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল থেকে শিক্ষার্থীদের অন্যত্র স্থানান্তর করে তাদের সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নীতিমালাতেও সংশোধন প্রয়োজন। বিএমডিসি সনদ পেতে এবং তা নবায়নে আবেদনকারী চিকিৎসকদের জন্য অবশ্যই লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু করতে হবে। এজন্য বিএমডিসি’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু আছে। কিন্তু এখানে দেশের যেকোনো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করলেই বিএমডিসি সনদ পেয়ে যাচ্ছে। এটি কোনোভাবেই আমাদের উন্নয়ন এবং উন্নয়ন স্বপ্নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ  নয়।  

অন্যদিকে, সরকারি এবং বেসরকারি খাতে কর্মরত জুনিয়র থেকে মধ্যম সারির সব চিকিৎসককে ৬-১২ মাসের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষ বিদেশেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর খরচ কোনোভাবেই একটি বোয়িং বিমান কেনার খরচ থেকে বেশি হবে না। জাতিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্রকে এ খরচ করতেই হবে।

এতসব হতাশার মধ্যে একটাই ভরসা। আর তা হলো আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই খাতের পরিবর্তনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আশা করি ওনার স্বার্থহীন, দূরদর্শী এবং গতিময় নেতৃত্ব এ অবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হব। রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্টস শিল্পে বিদেশি ব্র্যান্ড বায়ারদের চাপে যেমন শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। শিশু আয়ান এবং আহনাফ-দের  জীবনদানই হোক আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক