ছবি : সংগৃহীত

১৬ জানুয়ারি ২০২৪। বেড়াতে গিয়েছিলাম সেন্টমার্টিনে। ভ্রমণ মৌসুম হওয়ায় প্রবালবেষ্টিত দ্বীপটিতে তখন হাজারো পর্যটকের ভিড়। হোটেল-রিসোর্টগুলো পরিপূর্ণ। প্রতিদিন কয়েকটি লঞ্চে করে সেন্টমার্টিনে আসা যাওয়া করছিলেন পর্যটক। আমরাও পর্যটক হিসেবে উপভোগ করছিলাম নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনন্য সৌন্দর্য।

১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত একটি রিসোর্টে যাই। বেলা ভিস্তা নামের রিসোর্টটি বেশ সুন্দর। নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা সাগর পাড়ে আড্ডায় বসেছি। এমন সময় পূর্ব দিক থেকে বিকট এক শব্দ এলো। আকাশে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়লো। রাত তখন এগারোটা পেরিয়েছে। ভেবেছিলাম কোনো উৎসব চলছে। কিন্তু পর পর একই শব্দে কেঁপে উঠলো চারপাশ।

জানতে পারলাম সমুদ্র থেকে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে গোলা ছোঁড়া হয়েছে দেশটির ভেতরে। বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চলছে, কারণ সেন্টমার্টিন বরাবর ওপাশের স্থলভাগের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

কয়েক বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করছে আরাকান আর্মি। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালাইয়েন্স (Myanmar National Democratic Alliance Army-MNDAA) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানের নাম ‘অপারেশন ১০২৭’। 

সময়ের সাথে সাথে রাখাইন রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত হচ্ছে তাদের দখলদারিত্ব। সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চল থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও জান্তা আর্মির সাথে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ চলছে। তখনই আঁচ করতে পারছিলাম যে আরাকান আর্মি অনেক বেশি শক্তি অর্জন করেছে।

চিন রাজ্যের পালেতোয়া নদী বন্দর দখলের পর থেকে তাদের তৎপরতা বেড়েছে। ক্রমেই তারা রাখাইনের উত্তর থেকে বিজিপি ও সেনা ক্যাম্পগুলো দখল করতে করতে সমতলের দিকে যাচ্ছে। বলতে হয় রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের (আকিয়াব) দিকে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের একের পর এক কৌশলী আক্রমণের ফলে জান্তা বাহিনী দুর্বল হচ্ছে খবর পাচ্ছি। কেন্দ্রের সাথে তাদের অনেকগুলো স্থাপনার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিছু ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করেছে। দখল করতে করতে তারা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এগোচ্ছে রাখাইনের মধ্য-পূর্ব দিকে। রাজধানী ও সিত্তে বন্দর (Sittwe Port) পর্যন্ত দখলে নিতে তাদের লড়াই চলবে, হয়তো সেই লড়াই দীর্ঘমেয়াদি ও রক্তক্ষয়ী হবে।

এর প্রমাণ মিলল মাত্র পনেরো দিনের মাথায় এসে। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের ওপাশে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হলো। দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী—বিজিপির তুমব্রু রাইট ও তুমব্রু লেফট ক্যাম্প (ঢেঁকিবুনিয়া) দখল করে নিলো বিদ্রোহী আরাকান আর্মি।

রাখাইনের গৃহযুদ্ধ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের এখানে তেমন কিছু করার নেই। বিদ্রোহীদের সাথে তাদের সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে, এই দেশের নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, গোলাগুলিতে ভীতি ছড়িয়েছে বাংলাদেশ অংশে।

একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপও সামিল হয়েছে সেই যুদ্ধে। তাদের প্রত্যেকের শত্রু মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী ও সামরিক বাহিনী। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও (Rohingya Solidarity Organisation- RSO) নামের বিদ্রোহী সংগঠনের যোদ্ধাদের সরব ভূমিকা ছিল বলে জানতে পেরেছি।

বিদ্রোহীদের হামলার মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতা ও খাবার দাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা পালিয়ে আসে। সীমান্তবর্তী বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট যেমন ঘুমধুম, রহমতের বিল, হোয়াইক্যং দিয়ে মিয়ানমারের বিজিপি, আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অস্ত্র-গুলি সারেন্ডার করে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে। তারা আশ্রয় প্রার্থনা করে।

জেনেভা কনভেনশনের শর্ত মেনে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপি সদস্যদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সাগর পথে বিজিপি, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জন ফিরিয়ে নেয় মিয়ানমার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সৌজন্য ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ প্রশংসার দাবি রাখে। আর কেউ না হোক এই বিষয়ে মিয়ানমারকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

রাখাইনের গৃহযুদ্ধ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের এখানে তেমন কিছু করার নেই। বিদ্রোহীদের সাথে তাদের সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের প্রভাব বাংলাদেশে পড়ছে, এই দেশের নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, গোলাগুলিতে ভীতি ছড়িয়েছে বাংলাদেশ অংশে।

 ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি; ছবি : সংগৃহীত

কয়েক দফা দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার নিয়ম ভেঙে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। সবকিছুই বাংলাদেশ ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করছে। নানা রকম উসকানি থাকলেও তাতে সাড়া দেইনি আমরা। সীমান্তের ইস্যুকে আমরা সামরিক ইস্যুতে পরিণত হতে দেইনি। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সুচিন্তিত, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানের পরিপক্বতা সুস্পষ্ট হলো।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপি, সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারতো বাংলাদেশের জন্য আপাত এই সংকট। কিন্তু এর মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরে আরেকটি ঘটনা ঘটছে যা রীতিমতো উদ্বেগের। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, আরাকান আর্মির সাথে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করলেও জান্তা বাহিনীর পরাজয়ের পর দেশটিতে থাকা রোহিঙ্গা সংগঠনের ওপর চড়াও হচ্ছে আরাকান আর্মি। রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিজিপি ক্যাম্প দখলে নিয়েছে তারা।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিজিপি, সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারতো বাংলাদেশের জন্য আপাত এই সংকট। কিন্তু এর মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরে আরেকটি ঘটনা ঘটছে যা রীতিমতো উদ্বেগের।

রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যাও কম না। ঘটনাগুলো আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করছে। যা ভবিষ্যতের ইনক্লুসিভ রাখাইন গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ধারণা করেছিলাম যে, আরাকান আর্মি সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতি সংবেদনশীল হবে। কিন্তু আরও কিছু ঘটনায় সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সংগঠন—রোহিঙ্গা এফডিএমএন রিপ্রেজেন্টেটিভ কমিটি (Rohingya FDMN Representative Committee—Ro FDMN-RC) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর সংঘাত চলাকালে রাখাইনের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে ১০৮ জন, অপহরণ করা হয়েছে ৪ জনকে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সংগঠনটি এই ঘটনাকে বলছে গণহত্যা।

তাদের হিসাবে দেড় মাসে রাখাইনের ভেতরে বসবাসরত ১৯ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকদের নতুন করে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ।

এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সংগঠনটি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এই বিজ্ঞপ্তিতে দেড় মাসে সংগঠিত সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে বুথিডং ও কিয়াউকতও-এ।

এছাড়া মংডু, মিনবে ও সিত্তে এলাকায় সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। রাখাইনে নতুন করে সংঘটিত নৃশংসতা নিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে জোরপূর্বক বাস্ত্যুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সংগঠন Ro FDMN-RC।

বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেছে—Rohingyas are not the enemy of Rakhine. It is crucial for a peaceful and inclusive Arakan that Rohingya and Rakhine, as Arakanese brothers, recognize the shared responsibility in maintaining harmony. Our common enemy is the oppressive Myanmar Military, impacting both our communities indiscriminately অর্থাৎ ‘রোহিঙ্গারা রাখাইনদের শত্রু নয়। একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আরাকানের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে রোহিঙ্গা ও রাখাইনরা আরাকানি হিসেবে যৌথভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের শত্রু হলো মিয়ানমারের নিপীড়ক সামরিক বাহিনী, যা আমাদের উভয় সম্প্রদায় নির্বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

সাংবাদিক হিসেবে যেটুকু বুঝি তা হলো রাখাইনে চলমান সংঘর্ষ শেষ হলে দেশটির বিদ্রোহীরা রাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ নেবে। তখন রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি না হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া নতুন করে প্রশ্নের মধ্যে পড়বে। আর নিয়ন্ত্রণ হারানো সেনা ও বিজিপি ক্যাম্পগুলো পুনরুদ্ধারে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী যদি পাল্টা সামরিক হামলা চালায় সেই ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে বলা মুশকিল।

এদিকে মধ্য ফেব্রুয়ারির পর রাখাইনের মংডু, বুথিডংসহ মধ্য রাখাইনে বিদ্রোহীদের সাথে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী ও সেনা বাহিনীর সংঘর্ষ বাড়ছে। তুমব্রু, উনচিপ্রং সীমান্তের পর এখন অস্থির নাফ সীমান্ত।

মিয়ানমারের কাচিন, শান, চিন, রাখাইনসহ কয়েকটি রাজ্যে বিদ্রোহীদের সাথে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির দেশটি। এর মধ্য দিয়েও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। রাখাইনের সংঘর্ষ এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে নাকি পিছিয়ে দেবে সেইদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে বাংলাদেশকে।

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, দুইদিন ধরে নাফ নদীর ওপাশে ব্যাপক গোলাগুলি চলছে। গোলার শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ। বিকাল ৫ টার দিকে নাফ নদী পেরিয়ে একটি ট্রলার আসে শাহপরীর দ্বীপে। গুলিবিদ্ধ এক নারীসহ আশ্রয় প্রার্থী ৫ জন রোহিঙ্গা। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, সীমান্তের ১৯ জায়গায় প্রায় হাজার খানেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। ধারণা করছি সামনে কঠিন সময়। আশা করছি শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ।

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন