ছবি : সংগৃহীত

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) র‍্যাগিংয়ের নামে এক শিক্ষার্থীকে রাতভর উলঙ্গ করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে। ৭ ফেব্রুয়ারি, দিবাগত রাত ১২টা থেকে ভোররাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলে এই ঘটনা ঘটে। (ঢাকা পোস্ট, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাসহ ৪ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। (ঢাকা পোস্ট, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র রাজনীতির নামে ধর্ষক, নির্যাতক, ছিনতাইকারী, ফাও খাওয়ার লোক বানানোর কারখানায় পরিণত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতিকে আমরা হীন স্বার্থে গৌরাবান্বিত করে ছাত্রনেতাদের সব অপকর্ম বৈধ করছি।

এই রাজনীতির কারণে কত মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধার অপমৃত্যু ঘটেছে? মেধার অপমৃত্যুই ঘটেনি উল্টো সমাজ ও দেশের বোঝা সৃষ্টি করেছে।

ভারতের আইআইটিগুলোয় কি ছাত্র রাজনীতি আছে? নেই বলেই আইআইটি এত ভালো করছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সে কি ছাত্র রাজনীতি আছে? নেই বলেই শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারছে।

এইরকম সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বা পৃথিবীর অন্য দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও দলান্ধ রাজনীতি নেই। ছাত্ররা করবে ছাত্রদের রাজনীতি। যেই রাজনীতির মাধ্যমে ভালোর চর্চা করবে, আদর্শের চর্চা করবে এবং এইসব করবে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের অংশ হিসেবে।

স্বাধীনতার পর এত বছরের দলান্ধ বয়স্কদের হীন উদ্দেশ্য আদর্শ মেনে যেই রাজনীতি সেই রাজনীতিকে ছাত্র রাজনীতি নাম দিয়ে চালানো হচ্ছে। এই ছাত্র রাজনীতি আমাদের কী দিয়েছে? নেতৃত্ব তৈরি করতে পেরেছে?

এখান থেকে এত বছরে সৎ, আদর্শবান নেতৃত্বগুণে গুণান্বিত কোনো নেতা বের হয়েছে? যত দিন যাচ্ছে তত পচা, আবর্জনায় ডোবা নেতা তৈরি হচ্ছে। যারা ছাত্র হয়ে ছাত্রদের নির্যাতন করে, যারা নানা অপকর্মের সাথে নিজে জড়িত থাকে বা অন্যকে জড়িত থাকতে প্রশ্রয় দেয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনীতির মাধ্যমে সঠিক আদর্শিক নেতৃত্ব শেখার বদলে অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, ধর্ষণের মতো পরিকল্পিত ঘটনা ঘটছে।

এরাই বড় হয়ে এমপি মন্ত্রী হচ্ছে। তাহলে দেশ কীভাবে ভালো থাকবে? পৃথিবীর এমন একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন, যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি মূল রাজনীতির শাখা খুলে মূল দলের নেতাদের খুশি করতে রাজনীতি করা হয়?

ছাত্র রাজনীতি হবে যারা ক্যাম্পাসকে পরিচ্ছন্ন রাখতে নেতৃত্ব দেবে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে, সমাজের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেবে, তাদের জন্য। এইসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই ছাত্ররা সঠিক নেতৃত্ব শিখবে।

অথচ আজকের ছাত্র রাজনীতি এইগুলোর উল্টো যা আছে তার সবকিছু মধ্যে নিহিত। শিক্ষায় যে এত কম বাজেট বরাদ্দ দেয় তার বিরুদ্ধে কি ছাত্ররা প্রতিবাদ করে? বেশি বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য কি দাবি জানায়?

আবাসিক হলগুলোয় যে বস্তির চেয়েও খারাপ পরিবেশ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে? ছাত্রনেতারা অন্যায় করে নতুবা প্রশ্রয় দেয় বয়স্ক নেতাদের আশকারাতেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনীতির মাধ্যমে সঠিক আদর্শিক নেতৃত্ব শেখার বদলে অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, ধর্ষণের মতো পরিকল্পিত ঘটনা ঘটছে।

আমাদের বয়স্ক রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে ছাত্রদের ব্যবহার করলে ছাত্ররা এমন বেপরোয়া হবেই। অথচ আমাদের জাতীয় নেতারা এই আশকারা ও প্রশ্রয় এত বছর ধরেই দিয়ে আসছে।

ছাত্রদের মূল কাজ লেখাপড়া করা। এই কাজ করতে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কখনো উৎসাহ দেয় না। তাহলে এই দেশ কীভাবে সুন্দর, সুস্থ ও সভ্য হবে?

শিক্ষাঙ্গনে বর্তমান কলুষিত লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি থেকে মুক্তির জন্য ছাত্র রাজনীতি কিছুদিনের জন্য হলেও বন্ধ করা ছাড়া নতুন ধারার ছাত্র রাজনীতি সম্ভব নয়। একই কথা প্রযোজ্য শিক্ষক রাজনীতির ক্ষেত্রে। উল্টো পথে চলতে থাকা কোনোকিছু সঠিক পথে ঘুরাতে হলে টার্নিং পয়েন্টে গতি শূন্য হতে হয়। যার অর্থ হলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাকে থামতে হবে।

ছাত্র রাজনীতি মানে ছাত্রদের কল্যাণে রাজনীতি, শিক্ষার কল্যাণে রাজনীতি, সব অন্যায় রুখে দেওয়ার রাজনীতি, মানুষের কল্যাণের রাজনীতি। এর কোনো প্রতিফলন কি আমাদের বিশ্ববিদ্যাগুলোর ছাত্র রাজনীতিতে দেখা যায়? যায় না।

ছাত্র রাজনীতি মানে ছাত্রদের কল্যাণে রাজনীতি, শিক্ষার কল্যাণে রাজনীতি, সব অন্যায় রুখে দেওয়ার রাজনীতি, মানুষের কল্যাণের রাজনীতি। এর কোনো প্রতিফলন কি আমাদের বিশ্ববিদ্যাগুলোর ছাত্র রাজনীতিতে দেখা যায়?

আমাদের ছাত্ররা কাদের জন্য রাজনীতি করে? কাদের জন্য তাদের মহামূল্যবান ভবিষ্যৎ নষ্ট করে? তারা আসলে কারা? তারা হলো নিজেদের চেয়ার টিকিয়ে রাখতে অসৎ রাজনীতিবিদ।

এদের জন্যই ছাত্ররা বাবার এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকার শ্রাদ্ধ করে। এই পরিস্থিতি পৃথিবীর কোথাও দেখবেন না। ছাত্ররা কি বুঝতে পারছে, যে আপন স্বার্থে নিমগ্ন একদল দুষ্টলোক তাদের ঘাড়ে ভর করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে আর তাদের ভবিষ্যৎ দাবিয়ে দিচ্ছে? নিজের ভালো নাকি পাগলেও বুঝে। এরা তো পাগলও না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাইবা কাদের জন্য রাজনীতি করেন? আমি তো শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান উন্নয়নে শিক্ষক রাজনীতির কোনো ভূমিকা দেখি না। বরং উল্টোটা দেখি। রাজনীতির আবরণে যে শিক্ষক সমিতি হয় তাই শিক্ষকদের মান নষ্টের কারিগর।

নির্বাচনে সহজে জেতার জন্য শিক্ষকদের প্রমোশন যোগ্যতা নামাতে প্রশাসনকে চাপ দিয়ে নামাতে নামাতে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যেই জায়গায় নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ না থাকলে বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপকও হওয়া যায় না, সেই জায়গায় আমাদের এখানে অধ্যাপক, ভিসি, প্রোভিসি হয়ে যায়।

আসলে সবকিছুই উল্টো এই দেশে। শিক্ষকদের তো ব্যস্ত থাকার কথা পড়ানো, গবেষণা আর কীভাবে আরও ভালো মানের প্রশ্ন, আরও ভালো মানের কারিকুলাম প্রণয়ন করা যায় সেই কাজে নিয়ে। সেই কাজে তারা নেই।

ছাত্রদের যে কাজ করার কথাও তা বাদ দিয়ে তারা করছে ছাত্র রাজনীতি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি নামের অন্ধকার পথে হেঁটে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। এটা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়