ছবি : সংগৃহীত

বছর ঘুরে আবারও দুর্নীতির সূচক প্রকাশ করলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশের জন্য এই সূচক বরাবরই বিব্রতকর, বিশেষ করে শাসক দলের জন্য। দুর্নীতি এই দেশে নতুন কোনো সমস্যা নয়। এটা নিয়ে সরকারি দলের সমস্যাও নতুন নয়। প্রতিবারই যখন এই সূচক প্রকাশ করা হয়, যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তারা সবাই একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেয়। যারাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদেরই প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। দুর্নীতি প্রতিরোধ যেকোনো সরকারেরই রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তালিকায় উপরের দিকে থাকে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অন্যদের যেখানে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের কাছে টেনে নেওয়ার কথা, সেই জায়গায় উল্টো তাদের সমালোচনা করা হয়। এতে কাজের কাজ কী হয় জানা নেই। তবে দুর্নীতিপরায়ণরা যে আরও উৎসাহী হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

দুর্নীতিবাজদের উৎসাহী হওয়ার অবশ্য আরও অনেক উপাদানই সমাজে বিদ্যমান। অনেক পরিবারেই দুর্নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না। সমাজের একটা বড় অংশ একে কোনো অপরাধই মনে করে না, বরং ধরে নেয় অধিকার। প্রায় প্রতিটি পেশায় দুর্নীতি এভাবে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে অনেকদিন ধরেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও বিভিন্ন সময়ে তাদের নানা জরিপে সেইসব বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। আপাতত এটা নিয়ে কোনো আলাপ করার প্রয়োজন দেখছি না। কারণটা সবারই জানা।

বাংলাদেশে কোথায়, কীভাবে দুর্নীতি হয় এটা জানা বা বোঝার জন্য তেমন কোনো জরিপেরই আসলে প্রয়োজন নেই। এমনকি বিশেষজ্ঞ হওয়ারও দরকার নেই। এটা মোটামুটি সবারই জানা ঠিক কোন ধরনের শ্রেণিগোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত।

দুর্নীতি প্রতিরোধ যেকোনো সরকারেরই রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তালিকায় উপরের দিকে থাকে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অন্যদের যেখানে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের কাছে টেনে নেওয়ার কথা, সেই জায়গায় উল্টো তাদের সমালোচনা করা হয়।

দুর্নীতির ধরন-ধারণ ও আজকাল গোপন কোনো বিষয় নয়। মাত্রা বা ব্যাপকতা নিয়ে কারও কারও দ্বিমত থাকতে পারে। তবে এর বিস্তৃতি যে সমাজের প্রায় সব স্তরে পৌঁছে তা নিয়ে অনেকেই হয়তো একমত হবেন।

এটা এমন এক সমস্যা যা রাতারাতি দূর করা কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। তবে সদিচ্ছা থাকলে তা কমিয়ে আনা যেতেই পারে।  আর এই সদিচ্ছাটা সবার আগে জরুরি সরকারের দিক থেকে। সরকার যদিও বরাবরই বলে থাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের জিরো টলারেন্স। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের জাতীয় নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করলেও তাদের এই অঙ্গীকারের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু কার্যত এর কোনো প্রতিফলন নেই।

২০০১ সালে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। আমরা জানি তখন এটা আওয়ামী লীগ সরকারকে কীভাবে সমস্যায় ফেলেছিল। সেই বছর জাতীয় নির্বাচনে এইটাই প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, যার পরিণতিতে ফলাফল বিপর্যয় ঘটে তাদের।

এর ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকবার বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে থেকে যায় যদিও এর ব্যাপকতা খুব ধীরে হলেও কিছুটা কমতে থাকে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন আবার ক্ষমতায় আসে তার ঠিক আগের বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১০ নম্বরে উঠে আসে।

দেশে তখন ওয়ান ইলেভেন সরকার। দুর্নীতির বিপক্ষে ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। স্বাভাবিক কারণেই সূচকেও কিছুটা উন্নতি দেখা যায়। তবে এই উন্নতি ছিল সামান্যই। পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল দুর্নীতির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করা। নিজেদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার এই ঘোষণাটাই দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

তারা যখন ক্ষমতা বুঝে নেয় পরিস্থিতি ভালোর দিকে। বাংলাদেশকে ১৩তম  দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক হাত থেকে বুঝে নেয় আওয়ামী লীগ। তবে উন্নতির এই গ্রাফটা ধরে রাখতে পারেনি সরকার। টিআইবির সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

...সমাজের একটা বড় অংশ একে কোনো অপরাধই মনে করে না, বরং ধরে নেয় অধিকার। প্রায় প্রতিটি পেশায় দুর্নীতি এভাবে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে অনেকদিন ধরেই।

সোজা ভাষায়, বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, দুর্নীতি সারা বিশ্বেই কমবেশি আছে। দুর্নীতির অপবাদটা যেভাবে বাংলাদেশ নিয়ে দেওয়া হয়, তা মোটেও সত্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। টিআইবিকে বিএনপির দালাল বলে তিনি এই রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

কোনো সন্দেহ নেই এটা রাজনৈতিক বক্তব্য। দেশে দুর্নীতি আছে এটা যে কেবল টিআইবি'র একার পর্যবেক্ষণ তাও নয়। সরকারের কাছে তাই প্রত্যাশা ছিল দুর্নীতি আছে এটা মেনে নিয়ে এই বিষয়ে তাদের পদক্ষেপগুলো আরও স্পষ্ট করা।

সরকার অনেকবারই বলেছে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে তারা আরও শক্তিশালী করেছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন যে দুর্নীতি প্রতিরোধে খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অনেকটাই সিলেক্টিভ বলা যায়। সরকার যখন যেভাবে চেয়েছে তারা অনেকটা সেইভাবে কাজ করেছে। বড় বড় অনেক দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় আলোচিত হলেও তারা সেইসব বিষয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থীই তাদের সম্পদের যে হিসাব দেখিয়েছেন সেইটা তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অনেকে সম্পদের অবিশ্বাস্য কম মূল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু কমিশন এইসব বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দুর্নীতি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য না দিয়ে এসব বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।

যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সমস্যাকে স্বীকার করে নেওয়া। একে এড়িয়ে যাওয়া নয়। টিআইবির রিপোর্টের জবাবে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তার রোধে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। বরং এই সমস্যাকে স্বীকার করে নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে সেইটা বেশি কাজে দেবে।

আজাদ মজুমদার ।। যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ