রোমানিয়ায় ভেরোনিকার বাড়ি। থাকেন আমাদের ভবনে, মানে বেইজিংয়ে সিআরআই অ্যাপার্টমেন্টের এক নম্বর ভবনের ৪ তলায়। সেদিন লিফটে দেখা। তার স্বামী চায়না মিডিয়া গ্রুপের রোমানিয়া বিভাগের বিদেশি বিশেষজ্ঞ। হাই-হ্যালোর পর জানতে চাইলাম, ‘টিকার কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ফিল করেছ?’ ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘না, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। আসলে ইনজেকশন পুশ করার সময়ও টের পাইনি!’

গত ৯ এপ্রিল ছিল চায়না মিডিয়া গ্রুপের বিদেশি বিশেষজ্ঞদের টিকা নেওয়ার ডেট। ১৮ বছর বা তারচেয়ে বেশি বয়সীরা টিকা নিতে পারবেন, না নিলেও কোনো সমস্যা নেই। আমরা যারা বেতারে কাজ করি, তাদের সবার সামাজিক চিকিৎসা বিমা আছে। সুতরাং, আমাদের জন্য টিকা ফ্রি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের স্ত্রী’র জন্য (যাদের স্ত্রী আছেন আর কি!) প্রতি ডোজ টিকার জন্য দিতে হবে ৯৩.৫ ইউয়ান করে। ভেরোনিকা বললেন, ‘রোমানিয়ায় এক ডোজ টিকার জন্য যে পরিমাণ অর্থ গুণতে হচ্ছে, তার তুলনায় এই ৯৩.৫ ইউয়ান কিছুই না।’ রোমানিয়ায় ফাইজারের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করলেন, তার পরিচিত অনেকেই টিকা নিয়ে মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। দু’একজন এমনকি মারাও গেছেন। সেই তুলনায় চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেকের টিকা অনেক ভালো।

চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেকের ‘করোনাভ্যাক’ টিকা আমাদের দেওয়া হয়েছে। শুরুতে একদল চিকিৎসাকর্মী ব্রিফ করলেন। টিকা নেওয়ার পর ত্রিশ মিনিট কেন্দ্রে অপেক্ষা করতে হবে। কোনো সমস্যা হলে যাতে চিকিৎসা দেওয়া যায়। আরও বললেন, টিকা নেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা মদ খাওয়া যাবে না, সিফুড বা সামুদ্রিক খাবার খাওয়া যাবে না ও গোসল করা যাবে না। আমি হাসলাম। পরে যথাসময়ে বিভিন্ন কাগজপত্র স্বাক্ষরের পর টিকা নিতে বসেছি। প্রথম ডোজ দেওয়া হবে বাম হাতে। দ্বিতীয় ডোজ ডান হাতে। আমি বাম হাতের হাতা গুটিয়ে বসেছি, অপেক্ষা করছি সিরিঞ্জ ফোটানোর ব্যথার জন্য। কিন্তু কোথায় ব্যথা! নার্স একসময় বললেন, ‘হয়ে গেছে। তুমি যেতে পারো।’ আমি তো অবাক! আমি তাকে সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আমাকে টিকা দিয়েছ?’ নার্স হাসিমুখে (যদিও মাস্কের জন্য তা দেখা গেল না) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ পরে জেনেছি, ভেরোনিকার মতো অনেকেই সিরিঞ্জ ফোটানোর ব্যাপারটি টের পাননি। কেন এমন হলো সেটা একটা প্রশ্ন বটে। নার্সের দক্ষ হাতের কারণে, নাকি সিরিঞ্জের কারণে?

চীনে যেসব বিদেশি বাস করছেন, তারা এখন স্বেচ্ছায় টিকা নিতে পারছেন। স্থানভেদে অবশ্য টিকার মূল্য (যাদের সামাজিক বিমা নেই তাদের জন্য) কমবেশি হচ্ছে। কুয়াংচৌ চীনের মূল ভূ-ভাগের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে প্রায় ৮০ হাজার বিদেশির বাস। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশি। শুনেছি, সেখানে বাংলাদেশি কমিউনিটিও আছে। যেসব বাংলাদেশি দেশে গিয়ে আটকা পড়েননি, তারাও এখন ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। সেখানে এক ডোজ টিকার মূল্য ১০০ ইউয়ান মাত্র।

চীন ১৬০টিরও বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে মহামারি প্রতিরোধক সামগ্রী এবং শতাধিক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে টিকা সরবরাহ করেছে। 

চীনে উৎপাদিত কয়েকটি টিকা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের দুটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সেদিন সিএমজি’র শ্রীলংকান বিশেষজ্ঞ মতিলাল জানালেন, তার দেশে ৬ লাখ চীনা টিকা মজুত আছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র সবুজ সংকেত পেলেই সেগুলো ব্যবহার করা হবে। শুনেছি বাংলাদেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দেশে অনেক আগে থেকেই চীনা টিকার ব্যবহার শুরু করেছে। চীন যেমন ১৬০টিরও বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে মহামারি প্রতিরোধক সামগ্রী এবং শতাধিক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে টিকা সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, মঙ্গোলিয়া, বেলারুশের মতো দেশগুলোতে যেমন চীনের টিকা সহায়তা পৌঁছেছে, তেমনি সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, পেরু, চিলি, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, মরক্কো, সেনেগাল, ইউএই, তুরস্কের মতো দেশে টিকা রফতানিও করেছে ও করছে চীন।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখন চীনা টিকাই একমাত্র ভরসা। এসব দেশের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানও চীনা টিকা নিজেদের শরীরে গ্রহণ করেছেন। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী, চিলির প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার কার্যকারিতা চীনা টিকার চেয়ে বেশি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব টিকা অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে এগুলো পরিবহন করা কঠিন ও ব্যয়সাপেক্ষ। অন্যদিকে চীনা টিকা সংরক্ষণের ঝামেলা কম, পরিবহনও সহজতর। চীনা টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তেমন একটা নেই। আমি ও আমার স্ত্রী টিকা নেওয়ার প্রথম দুই দিন কিছু টেরই পাইনি। তৃতীয় দিন থেকে শরীরে হালকা ব্যথা ও জ্বর অনুভব করেছি। আমি অবশ্য চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে একটু বেশি ভুগেছি, কিন্তু তা রোজা রেখেও সহ্য করা গেছে। রোমানিয়ার ভেরোনিকা বা তার মতো অনেকেই খুব সামান্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই অনুভব করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র বিভিন্ন দেশে চীনের টিকা বলতেই একমাত্র ভরসা। কারণ, ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা পাওয়া দুষ্কর। পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো টিকা মজুত করছে। শুনেছি, একমাত্র কানাডা যত টিকা মজুত করেছে, তা দিয়ে সে দেশের সকল নাগরিককে পাঁচ ডোজ করে দেওয়া যাবে। ইউরোপের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রও টিকা মজুত করছে। কোনো কোনো দেশ টিকা রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নিন্দুকেরা এর নাম দিয়েছেন ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’। এই বাদের মূল কথা ‘আগে আমরা, পরে অন্যরা’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই টিকা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে, বলেছে, এর ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র দেশগুলো সময়মতো টিকা পাবে না। আর যদি বিশ্বের সকল দেশ পর্যাপ্ত টিকা না পায়, তবে বিশ্ব থেকে কোভিডও নির্মূল হবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মূলত ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ মোকাবিলা করতেই ‘কোভ্যাক্স’ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এতে যোগ দিয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় এক কোটি টিকা সরবরাহ করবে। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রায় ৪ কোটি টিকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে অর্ধেকই গেছে আফ্রিকার ৪০টির বেশি দেশে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র লক্ষ্যমাত্রা এতে অর্জিত হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ এবং বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে ভারতে নতুন করে মহামারির ব্যাপক বিস্তৃতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র জন্য টিকা সংগ্রহ কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে।

এ প্রেক্ষাপটেই চীনা টিকার বিশ্বায়ন হচ্ছে। চীন শুরু থেকেই কোভিড টিকাকে বিশ্বের জনগণের পণ্য ঘোষণা করেছে। বিশ্বের চাহিদা মেটানোর জন্য চীন নতুন নতুন টিকা নিয়ে গবেষণাও অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি নতুন একটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন করেছে সরকার। যদিও চীনা টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মানদণ্ড অনুসারেই ব্যবহারযোগ্য, তথাপি চীনা গবেষকরা টিকার কার্যকারিতা বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দু’তিন ধরনের টিকা পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করলে টিকার কার্যকারিতা বাড়ে কি না, তাও পরখ করার কথা বিবেচনা করছেন তারা। আবার ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে টিকা তৈরির বিষয়টিও বিবেচনা করছে চীন।

কিন্তু চীনের এই প্রচেষ্টাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম। কেউ কেউ চীনের বিরুদ্ধে ‘টিকা কূটনীতির’ অভিযোগ তুলছে তো কেউ কেউ চীনা গবেষকের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে তুলে ধরে বলতে চাইছে যে, চীনা টিকা কার্যকর নয় বা কম কার্যকর।

ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার কার্যকারিতা চীনা টিকার চেয়ে বেশি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব টিকা অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে এগুলো পরিবহন করা কঠিন ও ব্যয়সাপেক্ষ। অন্যদিকে চীনা টিকা সংরক্ষণের ঝামেলা কম, পরিবহনও সহজতর।

এটা এখন সবাই জানে যে, পাশ্চাত্য দেশগুলো চীনের সমালোচনা করার কোনো সুযোগ হাত ছাড়া করে না। মহামারিকে কেন্দ্র করে চীনের কম সমালোচনা হয়নি। চীনের উহান লকডাউন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাশ্চাত্যের মিডিয়া। পরে দেখা গেল মহামারি ঠেকাতে গোটা দুনিয়া জুড়েই চীনা স্টাইল ফলো করার চেষ্টা চলছে। শুরুর দিকে যেসব দেশ চীনের স্টাইল ফলো করেছে, সেসব দেশ মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে; যারা করেনি, তারা ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করেছে ও করছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ চিকিৎসা ম্যাগাজিন ‘দ্যা ল্যানসেট’ মহামারি নিয়ন্ত্রণে চীনের অভূতপূর্ব সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। আমার বিশ্বাস, চীনের টিকাও একসময় আজকের বিরুদ্ধবাদীদের প্রশংসা কুড়াবে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীন চলতি বছরের মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চীন নিজ দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে চায়। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের পক্ষে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব।

আগেই বলেছি, চীন কোভিডের টিকাকে বিশ্বের জনগণের পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং টিকা আবিষ্কারের আগেই সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং বলা বাহুল্য, বিশ্বের তিনিই প্রথম সরকার প্রধান যিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি ও তার দেশ রক্ষা করেছে। বিশ্বের সব দেশের জন্য টিকা সহজলভ্য করতে চীন এককভাবে ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে থাকায় এটা করা সহজতর হয়েছে। চীন হয়ে উঠেছে উন্নয়নশীল বিশ্বের ভরসাস্থল।

সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, মহামারি সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্ববাসীর ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বে এখনও হু হু করে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং বিশ্বের অর্থনীতিও মন্দার হুমকির মধ্যে আছে। এ অবস্থায় মহামারির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে। তিনি বিশ্বের সকল দেশকে ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’-এর বিরুদ্ধে এক হওয়ার আহ্বানও জানান।

বস্তুত, এখন টিকার জাতীয়তাবাদ নয়, বরং চাই টিকার বিশ্বায়ন। অর্থনীতির বিশ্বায়নের এই যুগে কোভিড-১৯ ভাইরাসকে পরাজিত করতে এর কোনো বিকল্প নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি দেশ বা অঞ্চলও ভাইরাসের অভয়ারণ্য হিসেবে থেকে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বিশ্ব মহামারি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। এই সত্য চীন বহু আগেই উপলব্ধি করেছে ও প্রচার করেছে। পাশ্চাত্যের উপলব্ধি হয় কি না এবং তারা টিকার জাতীয়তাবাদ ছেড়ে, টিকার বিশ্বায়নের দিকে মুখ ফেরায় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)

alimulh@yahoo.com