আলোর নিচে অন্ধকার!
২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনকালটা বাংলাদেশের এক অন্ধকার অধ্যায়। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের উত্থান, গ্রেনেড হামলা—সব মিলিয়ে এই সময়টা বাংলাদেশ ভুলে যেতে চাইবে সবসময়। তবে অন্য সব সূচকের মতো বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারে ছিল এই সময়টায়।
বিদ্যুতের আসা-যাওয়া ছিল নিত্যদিনের খেলা। কখন বিদ্যুৎ যায়; তারচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, কখন বিদ্যুৎ আসে। বিদ্যুৎ শুধু বাতিতেই আলো দেয় না। বিদ্যুৎ হলো সভ্যতা, অগ্রগতি আর উন্নয়নেরও চালিকাশক্তি। বিদ্যুৎ না থাকলে বা কম থাকলে বা ঘাটতি থাকলে অগ্রগতির চাকাও স্থবির হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় নিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার বা চ্যালেঞ্জ ছিল বিদ্যুৎ। মানতেই হবে সেই চ্যালেঞ্জ সরকার সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছে। ৪ হাজার মেগাওয়াট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৬ হাজার মেগাওয়াট।
আরও পড়ুন
খাম্বা নয়, আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। টাকা এবং জ্বালানি থাকলে এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে চাহিদামতো বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এখনো যে লোডশেডিং হয়, তার দায় উৎপাদন সক্ষমতার নয়, আর্থিক অসক্ষমতার।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অবশ্যই গর্ব করার মতো। তবে সেই সক্ষমতা আমরা কিনেছি চড়া দামে।
একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বছরের পর বছর বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও সর্বোচ্চ ছাড়। প্রথমদিকে এই চড়া মূল্য নিয়ে কেউ কথা বলেনি, প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায়, একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ, অপচয়মুক্ত, ভর্তুকিমুক্ত বিদ্যুৎ খাত এখন সময়ের দাবি।
বিদ্যুৎ খাতকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও সর্বোচ্চ ছাড়। প্রথমদিকে এই চড়া মূল্য নিয়ে কেউ কথা বলেনি, প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায়, একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ, অপচয়মুক্ত, ভর্তুকিমুক্ত বিদ্যুৎ খাত এখন সময়ের দাবি।
প্রশ্ন ছাড়া অঢেল টাকা পেলে যে কেউ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। কিন্তু কতটা কম দামে, কতটা নির্বিঘ্নে, অপচয় কতটা কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়া যাবে; সেইটাই এখন প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের শুরুর সময় এখন। ধারাবাহিকতার কারণে এই সরকারের সামনে কোনো হানিমুন পিরিয়ড নেই। তারচেয়ে বড় কথা হলো, অন্য অনেক মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী পরিবর্তিত হলেও বিদ্যুৎ খাতে শুধু সময়ের ধারাবাহিকতা নয়, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অক্ষুণ্ন রয়েছে। তাই বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আর প্রত্যাশার জায়গা নেই। এখন সময় প্রত্যাশা পূরণের।
বিদ্যুৎ খাতে আয়-ব্যয়ে কখনোই ভারসাম্য ছিল না। বরাবরই আমরা বেশি দামে উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করি। তাতে ভর্তুকি থাকেই। কিন্তু বছরের পর বছর চলতে থাকায় ভর্তুকির পাহাড় জমেছে। চড়া দামে উৎপাদন আর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে বসিয়ে অর্থ দেওয়াতে পুরো খাতটাই এখন বসে যাওয়ার দশা।
আরও পড়ুন
সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের খাত এখন পরিণত হয়েছে সবচেয়ে বড় বোঝায়। আলোর নিচেই জমাট বেঁধেছে গাঢ় অন্ধকার। বিদ্যুৎ খাত যেন সরকারের এক শ্বেতহস্তী। বিদ্যুৎ খাত মোটামুটি চলছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে টালমাটাল অবস্থা, তার ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ডলারের চড়া মূল্য, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া—সব মিলিয়ে দারুণ চাপে পড়ে যায় বিদ্যুৎ খাত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে বিদ্যুৎ খাতের দেনা প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
পিডিবি তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। রিজার্ভ সংকটের কারণে চাইলেও সরকার আগের মতো বিদ্যুৎ খাতকে টাকা দিতে পারছে না। ফলে বিদ্যুৎ খাত পড়েছে উভয় সংকটে। একে তো দেনার প্রবল চাপ, তার ওপর উৎপাদন ঠিক রাখার চ্যালেঞ্জ।
উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যেও। তখন ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর বাড়তি চাপও অনেক বেশি হয়ে ফিরে আসে সাধারণ মানুষের কাছে। তাই বিদ্যুৎ খাতে সরকারের কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই।
এই সমস্যার কিছুটা আমরা গত মৌসুমেই আঁচ করতে পেরেছি। অনেকদিন পর বাংলাদেশ ফিরে গিয়েছিল লোডশেডিংয়ের যুগে। যদি নাটকীয় কিছু না ঘটে তাহলে ২০২৪ সালের গ্রীষ্ম মৌসুমেও লোডশেডিংয়ের সাথে বসবাস করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। শঙ্কার বিষয় হলো, এইবার গরম কাল লম্বা হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।
আগেই বলেছি বিদ্যুৎ খাতের মূল সমস্যা অদক্ষতা, অপচয় আর ভর্তুকি। আইএমএফও ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা বা শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। কিন্তু বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন, আসলে অসম্ভব।
ভর্তুকি কমিয়ে আনার সহজ উপায় দাম বাড়িয়ে দেওয়া। সরকার দাম বাড়িয়েছেও। কিন্তু ভর্তুকি শূন্য করতে যতটা দামা বাড়ানো দরকার, ততটা বাড়ানো অসম্ভব। আইএমএফ যাই বলুক, বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, কম দামে বিক্রি করা দিনের পর দিন সম্ভব নয়, উচিতও নয়।
আরও পড়ুন
আর এখন অর্থনীতি যে প্রবল চাপের মুখে আছে, তাতে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আসলে কোনো বিকল্প হয়তো নেই। কিন্তু করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতির যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপরও।
দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট। মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। মানুষ এখন ব্যয় সংকোচন করে টিকে আছে। সাধারণ সময়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ালে হয়তো তার তেমন প্রভাব পড়তো না। কিন্তু এখন মানুষ যেভাবে টিকে আছে, তাদের মাথার ওপর খরচের বিশাল বোঝা, বিদ্যুতের বাড়তি দাম তাতে শাকের আঁটি হলেও চাপ বাড়াবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র।
উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যেও। তখন ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর বাড়তি চাপও অনেক বেশি হয়ে ফিরে আসে সাধারণ মানুষের কাছে। তাই বিদ্যুৎ খাতে সরকারের কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই। আর বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি, অপচয় বন্ধ করতে পারলে দাম না বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো সম্ভব নয়। তবে সেচ এবং কম ব্যবহারকারী গরিব মানুষের জন্য দাম কম বাড়িয়ে, বেশি ব্যবহারকারী উচ্চবিত্তের মানুষদের জন্য বেশি দাম বাড়িয়ে কিছুটা সমন্বয় করা যেতে পারে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরাও জানেন, জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ আছে সামনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে যেমন কৌশলী হতে হবে, সাধারণ মানুষকেও সাশ্রয়ী হতে হবে। জ্বালানি সবসময়ই মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয়, অর্থনীতির লাইফলাইন। তাই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সেইটা ধরে রাখা জরুরি।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ