ছবি : সংগৃহীত

দেশের বেশিরভাগ এলাকায় কনকনে ঠান্ডায় জেঁকে বসেছে শীত। এর মধ্যে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে সাথে বৃষ্টি। শীত মৌসুমে এর আগে কখনো এই রকম পরিস্থিতি দেখা যায়নি। এবারের শীতে হাড়ে পর্যন্ত কাঁপন ধরে যাচ্ছে।

ডিসেম্বরের মধ্যভাগে যখন পৌষ মাস আসলো, তখন ঢাকাবাসীর অভিযোগ, আক্ষেপ তীব্র শীত পড়ে না কেন! এখন যখন কয়দিন ধরে শীত পড়তে শুরু করেছে, আমরা অভিযোগ করতে শুরু করেছি, ঢাকায় হঠাৎ এত শীত কেন! 'ঢাকায় তেমন শীত পড়ে না' কথাটার তীব্র জবাব দিতেই বোধহয় হঠাৎ করে রাজধানী ঢাকায় কনকনে বাতাস নিয়ে জেঁকে বসল তীব্র শীত।

কয়েকদিন আগেও তাপমাত্রা ছিল সহনীয় পর্যায়ে। তাহলে হঠাৎ ঢাকায় এমন তীব্র শীত পড়ার কারণ কী? কেউ কেউ একে ‘অস্বাভাবিক’ও বলছেন। ২০২৪ সালে দেশের ২১ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার খবর পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো জেলাতেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কিন্তু তারপরও মানুষ কেন ‘অস্বাভাবিক’ শীতের কথা বলছে?

যেসব কারণে বাংলাদেশে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে, তার একটি হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। কুয়াশা বাড়ছে কেন? বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে সম্প্রতি বেশ কয়েকবারই ঢাকাকে শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় দেখা গেছে।

যানবাহন, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানান কারণে সারাদেশেই আগের চেয়ে বায়ু দূষণ বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে। দূষিত এই বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা মিশে রয়েছে, যা মেঘ ও কুয়াশা তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যেই আবার ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূষিত বায়ু প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

কুয়াশা, ধুলা আর ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে তা হয়ে উঠেছে ধোঁয়াশা। ভারতের দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার অঞ্চলে কুয়াশা অঞ্চল ছিল। তা ধীরে ধীরে বেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সাধারণত সেই কুয়াশা অঞ্চল দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত এসে থাকে। কিন্তু এবার এই কুয়াশা অঞ্চল দেশের মধ্যাঞ্চল ছাড়িয়ে ঢাকা পর্যন্ত এসেছিল। সেই কুয়াশা অঞ্চল ঢাকা হয়ে বরিশাল ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে।

ঘন কুয়াশার প্রবাহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কোনোকিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। উড়োজাহাজ উড়তে পারছে না সময়মতো, ফেরিঘাটে আটকে আছে ফেরি, মহাসড়কে গাড়িগুলো চলছে পিঁপড়ার গতিতে, দশ হাত দূরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না বলে।  এজন্যই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে।

যেসব কারণে বাংলাদেশে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে, তার একটি হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। কুয়াশা বাড়ছে কেন? বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে সম্প্রতি বেশ কয়েকবারই ঢাকাকে শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় দেখা গেছে।

আর এই দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। অর্থাৎ সূর্য বেশিক্ষণ আলো দিতে পারছে না। স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন থেকে চার ঘণ্টায়। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। ফলে শীতও বেশি অনুভূত হচ্ছে।

বস্তুত কোনো অঞ্চলের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেইখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। আর পার্থক্য যদি পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে, সেইখানে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়।

দিনের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় মূলত ঠান্ডাটা বেশি অনুভূত হচ্ছে। সেই তুলনায় রাতের তাপমাত্রা তেমন কমেনি। যেহেতু দিনের তাপমাত্রাসহ রাতের তাপমাত্রা কাছাকাছি হওয়ায় মানুষকে দীর্ঘসময় একই তাপমাত্রায় থাকতে হচ্ছে বিধায় শীতটা অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। তবে যদি সকাল ৮/৯টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকার পর সূর্য উঠতো তাহলে দিনের তাপমাত্রা বাড়ত। তখন কিন্তু মানুষের মধ্যে এই তীব্র শীত অনুভূত হতো না। যেহেতু দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তাই হঠাৎ করেই শীতটা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে।

ঘন কুয়াশার পাশাপাশি হিমেল হাওয়ায় ঠান্ডাটা আরও তীব্রভাবে বেড়েছে। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসছে বাতাস, যাকে আমরা ‘উত্তরা বাতাস’ বলে থাকি। এই বাতাস কনকনে হিম বয়ে এনে হাড় কাঁপুনির সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। এটিও শীতের তীব্রতা বাড়ার কারণ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, জানুয়ারি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে শীতলতম মাস। এই মাসে বেশি শীত পড়বে এটিই স্বাভাবিক। এই সময় উপমহাদেশে ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাস খুব ঠান্ডা হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘জেড স্ট্রিম’ বা প্রচণ্ড গতিবেগ সম্পন্ন বাতাস কখনো নিচে নেমে আসছে, কখনো উপরে উঠে যাচ্ছে, যে কারণে শীতের প্রকোপ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি।

রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে সকালে ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের কারণে, মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া বিকেল থেকেই তাপমাত্রা নিম্নগামী হওয়ায় সন্ধ্যার পরপরই তীব্র ঠান্ডায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার ও দোকানপাট।

ঠান্ডাজনিত নানা রোগ নিয়ে শিশুসহ বয়স্ক রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে হাসপাতালগুলোয়। ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক ও নৌপথে যানবাহন চলাচলে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক এলাকায় ঘন কুয়াশার কারণে ৫০ থেকে ১০০ মিটারের দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। এই আবহাওয়ায় কৃষিখাতে প্রভাব ফেলবে। ঘন কুয়াশা ও বাতাসের কারণে মৌসুমি ফসলের ক্ষতি হতে পারে।

শীতের এই সময়টায় ঠান্ডাজনিত বেশকিছু বাড়তি রোগব্যাধি দেখা যায়। প্রতিবছর শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই সময়টা বেশ জটিলতা তৈরি করে। যেমন সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, সাময়িক জ্বর, কোল্ড অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এই সময় বাতাসে ধুলাবালি বেশি থাকায় অনেকের অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা যায়।

বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের কাশি, কোল্ড অ্যালার্জির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। ঠিক সময়ে শনাক্ত করা না গেলে অনেক সময় তা নিউমোনিয়াতেও রূপ নিতে পারে।

বস্তুত কোনো অঞ্চলের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেইখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। আর পার্থক্য যদি পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে, সেইখানে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়।

শীতকালে মশাবাহিত ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু রোগসহ নানা ভাইরাস জ্বরের রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এই সময় অনেক স্থানে মশার প্রকোপও বাড়ে। ডেঙ্গু বর্ষাকালীন রোগ হলেও এখন শীতকালেও এর বিস্তার দেখা যায়। তাই মশার কামড়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

হঠাৎ করে ঠান্ডার কারণে শিশুদের, অনেক সময় বড়দেরও পাতলা পায়খানা হতে দেখা যায়। বিশেষ করে যখন বেশি ঠান্ডা পড়ে, তখন বয়স্কদেরও পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে।

শীতের সময় শুষ্কতার কারণে শরীরের ত্বকও শুষ্ক হয়ে ওঠে। ফলে অনেক সময় চুলকানি বা ব্যথা অনুভব হতে পারে। অনেক সময় অ্যালার্জির কারণেও এটি হতে পারে। বিশেষ করে যাদের ধুলাবালিতে অ্যালার্জি হয়।

শীতের সময় বাতাসে ধুলাবালি বেড়ে যায়। এছাড়া ঢাকার মতো বড় শহরে বাতাসে নানা ধরনের ধাতুর পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যাদের ডায়াবেটিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, শীত তাদের জন্য বিশেষ সমস্যার কারণ হতে পারে।

শীতের সময় করণীয়—

প্রথমত, শীতের ঠান্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। গরম কাপড় পরতে হবে, কান ও হাত ঠেকে রাখতে হবে, গলায় মাফলার ব্যবহার করতে হবে। খালি পায়ে থাকবেন না।

ঠান্ডা একেবারে এড়িয়ে চলতে চলতে হবে। স্নান বা হাতমুখ ধোয়া থেকে শুরু করে সবসময়ে কুসুম গরম জল ব্যবহার করতে হবে। খাবার পানির ক্ষেত্রে হালকা গরম পানি মিশিয়ে খেতে পারলে ভালো। এই সময় ঠান্ডা খাবার, যেমন আইসক্রিম, কোক ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত।

বাইরে ধোঁয়া বা ধুলা এড়িয়ে চলার সমস্যা মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রয়োজনে ত্বকের চাহিদা অনুযায়ী ক্রিম ব্যবহার করা উচিত।

শীতে উষ্ণ থাকতে হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন।

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। শীতের সময়েও প্রচুর পানি খাওয়া উচিত। গরম স্যুপ, আদা চা, গ্রিন-টি ইত্যাদি উষ্ণ থাকতে সাহায্য করবে।

এছাড়া ভিটামিন-সি রয়েছে এমন খাবার যেমন জলপাই, কমলা, লেবু ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে। এগুলো একপ্রকার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।

শিশুরা অনেক সময় শরীরে গরম কাপড় রাখে না বা খুলে ফেলে। তাই তাদের দিকে সতর্ক নজর রাখা উচিত।

শীতকালেও নিয়মিতভাবে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে।

শীতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তীব্র শীতে ছিন্নমূল মানুষের রাত কাটে অসহনীয় দুর্ভোগে। হাড় কাঁপানো শীতে ইট-বালুর শহরে এমনই নাজেহাল অবস্থা ছিন্নমূল মানুষের।

আমরা যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, ছিন্নমূল খেটে খাওয়া মানুষ তখন শীতের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকেন নতুন সূর্যের অপেক্ষায়। তাদের গরম জামাকাপড় বা কাঁথা-কম্বলেরও অভাব রয়েছে। এই অবস্থায় ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে তারা সহজেই আক্রান্ত হয়। পুষ্টিহীনতার শিকার এসব মানুষের শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে।

নবজাতকদের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। শীতে খালবিল, পুকুর, নালার পানি প্রায় শুকিয়ে আসে। সামান্য যে পানি থাকে তাতে দূষণ হয় বেশি। এই পানি ব্যবহার করে মানুষ সহজেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। আমরা আশা করি, দেশের যেসব এলাকায় আক্রান্তের হার অনেক বেশি, সেইসব এলাকায় সরকার বিশেষ সেবা কর্মসূচি গ্রহণ করবে।

হাড় কাঁপানো শীতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি একটু সাহায্যের আবেদন তাদের। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শীতার্ত মানুষদের সহায়তায় নানা সংগঠন, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণের উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়।

ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu