ছবি : সংগৃহীত

কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান তথা তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নয়নশীল অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বেশকিছু সূচকে আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের চেয়ে এগিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন, ঘোষণা করেছেন স্মার্ট বাংলাদেশের। আর এই স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট নাগরিক।

মোটকথা স্মার্ট নাগরিক হতে হলে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষা। আর স্মার্ট শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন করতে পেরেছি? নাকি বারবার শিক্ষাব্যবস্থায় নতুনত্ব নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছি?

‘নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নে প্রয়োজনে অবশ্যই পরিবর্তন আনা হবে’ নতুন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষা নিয়ে এমন একটি ভাবনা জানিয়েছেন তিনি। সারমর্ম করলে দাঁড়ায় বর্তমানে যে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন তিনি। যেহেতু নতুন শিক্ষাপদ্ধতি বেশ সমালোচনা ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে, সেই কারণে অভিভাবকেরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেইদিক থেকে ভাবলে শিক্ষামন্ত্রীর ‘মূল্যায়নে প্রয়োজনে পরিবর্তন’ এই ভাবনাটি ইতিবাচক ধরেই নেওয়া যায়। 

প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন করতে পেরেছি? নাকি বারবার শিক্ষাব্যবস্থায় নতুনত্ব নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছি?

তবে আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, শিক্ষাক্রম বা পদ্ধতি নিয়ে ১৫ বছর ধরে চলে আসা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ বা শিক্ষা পদ্ধতির পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের ইতি টানবেন কে? ঠিক কত বছর পার হলে টেকসই শিক্ষাপদ্ধতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে? 

একটু পেছনে ফেরা যাক, ১৯৭২ এর ৬টি শিক্ষানীতি পার করে করে ২০১০ সালে ৭ম জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন করা হয়। ওই শিক্ষানীতির ২১ নং অধ্যায়ে পরীক্ষা ও মূল্যায়নের জন্য যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে আছে—

এক. মুখস্থবিদ্যা নয় বরং শিক্ষার্থী বিষয়বস্তুকে কতটুকু আত্মস্থ করতে পেরেছে তা মূল্যায়নের লক্ষ্যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা।

দুই. পরীক্ষা ও মূল্যায়নের জন্য অভিন্ন কৌশল অনুসরণের নিয়মনীতি নির্ধারণ করা।

তিন. প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে যেন এই পদ্ধতি বুঝতে পারে তা ঠিক করা।

প্রথম ও দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের মুখস্থ নির্ভর বিদ্যা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সাল থেকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এই পদ্ধতি চালুর সময়ে বলা হয়েছিল-নোট-গাইড থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হবে। কিন্তু আদৌ কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?

দক্ষতার অভাবে শিক্ষকরা ক্লাসে সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠ সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম হচ্ছেন না। যেসব অভিভাবক অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাবে তাদের সন্তানদের কোচিং প্রাইভেটে দিতে পারছেন না তাদের বাইরেও কি শিক্ষার্থীদের কোচিং, প্রাইভেট বা সহায়ক বইয়ের অভিমুখিতা কমেছে?

সকলেই এক বাক্যে উত্তর করবেন, না কমেনি। গ্রাম থেকে শহর প্রতিটি জায়গায় গাইড বই ও কোচিং প্রতিষ্ঠানের আধিক্য দিয়ে এই ধারণা পাওয়া যায়। শিক্ষা সহজ করার প্রচেষ্টা হলেও অভিভাবকদেরও ভোগান্তি কমেনি।

তৃতীয় লক্ষ্য ছিল—শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই যেন প্রশ্নটি বোঝেন, পদ্ধতিটি বুঝতে পারেন। তবে ২০২২ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সর্বশেষ তদারকি প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষক ঠিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না।

একই প্রতিবেদনে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে—১৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধার করে আনা প্রশ্নে পরীক্ষা নিতেন। অর্থাৎ এই লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। সাথে যুক্ত হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে এমন প্রশ্ন প্রণয়ন করে শিক্ষকদের আলোচনায় আসা।

শিক্ষা প্রশাসন এবং একাডেমিশিয়ানরা বিরক্তি প্রকাশ করে তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন, গাইড বইয়ের একটি প্রশ্নে যে নাম রয়েছে সেই নামের পরিবর্তে অন্য নাম ব্যবহার করে প্রশ্ন পাল্টে ফেলা হয়েছে। উদ্দীপক নামের ছোট লেখাটির সাথে কখনো কখনো সাদৃশ্য নেই নিচের প্রশ্নের।

যা সৃজনশীল উত্তর প্রদানের নামে মুখস্থ বিদ্যা ও অযাচিত শব্দ আঁকিঝুঁকি করে খাতা ভর্তি করার হার বাড়িয়েছে। সাথে বাড়িয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হারও। অর্থাৎ পদ্ধতিটি শিক্ষাকে উল্টো পথে যাত্রায় সাহায্য করেছে বলে বারবার উল্লেখ করেছেন তারা।

আরেকটি বিষয় সামনে আনা যাক, ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল—প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে, মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত হবে। উচ্চবিদ্যালয়গুলোয় দ্বাদশ শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। শিক্ষকদের জন্য হবে আলাদা বেতন কাঠামো। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো কমিশন করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

এর পরিবর্তে একসময় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা ২০০৯ সালে হঠাৎ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় বদলে যায়। প্রথমে শুধু সাধারণ শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকলেও মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (পঞ্চম শ্রেণির সমমান) পরীক্ষাও চালু হয়।

তবে আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, শিক্ষাক্রম বা পদ্ধতি নিয়ে ১৫ বছর ধরে চলে আসা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ বা শিক্ষা পদ্ধতির পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের ইতি টানবেন কে? ঠিক কত বছর পার হলে টেকসই শিক্ষাপদ্ধতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে?

২০১০ সালে শুরু হয় জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। ২০২২ সালে এসে উভয় পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়। শিক্ষা নিয়ে পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করলে দাঁড়ায়, সবগুলোই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের অংশ হয়ে আছে।

১৫ বছরে দুইজন শিক্ষামন্ত্রী পরিবর্তিত হয়েছেন। তাদের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। নতুন শিক্ষামন্ত্রী প্রথম দিনেই পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। এর মাধ্যমে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টিকেই কি মনে করিয়ে দিচ্ছে না?

যে পরিকল্পনার মধ্যে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কমানো, উপকরণ ব্যবস্থাপনা, টেকসই শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষকদের সময়োপযোগী শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেওয়ার সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলা যায়। যার প্রভাব সাধারণ শিক্ষায় পড়তে শুরু করেছে বলে মনে হয়।

সম্প্রতি রাজশাহীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের ভাষ্যমতে, এই বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থী নাকি অনেক বছরের তুলনায় বেশি ভর্তি হয়েছে তাদের স্কুলে। অভিভাবকদের অনেকেই বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বেশ নিশ্চিত। তারা বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত।

এই অবস্থার উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। কোন পদ্ধতি গ্রহণ করলে আমরা নতুন প্রজন্মকে দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারবো সেই বিষয়ে আশু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। যে পদ্ধতিই আমরা গ্রহণ করি না কেন তা যেন টেকসই হয় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়