মাথায় ইট পড়ে দীপান্বিতা বিশ্বাসের মৃত্যুর দায় কার?
দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদে কে, কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, কোন মন্ত্রী কেন বাদ পড়লেন সেইসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর ১০ জানুয়ারি ২০২৪ রাজধানীতে মগবাজার এলাকায় অফিস ফেরত ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপু মৃত্যুবরণ করলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট কার্যালয়ে কাজ করতেন দীপান্বিতা। প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে ফেরার পথে মালিবাগে নেমে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। কিছুদূর যেতেই ওপর থেকে মাথায় এসে পড়ে একটি ইট। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
দীপান্বিতার মৃত্যুর দৃশ্যটি স্পষ্ট চিত্রায়িত হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায়। এই ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। রমনা থানা পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে, ওরা এখনো জানে না কেউ কি ইচ্ছে করে ছুড়ে মেরেছে ইটটি নাকি দুর্ঘটনাক্রমে এসে পড়েছে?
আরও পড়ুন
প্রায় একইরকম ঘটনায় পথচারীর মৃত্যু এর আগেও হয়েছে ঢাকা শহরে—কখনো রাস্তায় নির্মাণাধীন ফুটওভার ব্রিজ ভেঙে পড়ে বা কখনো নির্মাণাধীন উড়াল সড়ক ভেঙে পড়ে। কিন্তু এই পর্যন্ত এইরকম ঘটে যাওয়া মৃত্যুর জন্য কেউ শাস্তি পায়নি বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি বা কাউকে ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ এই যে দীপান্বিতার মৃত্যু হলো, এসব ঘটনার পর যে প্রশ্নটা সামনে আসে তা হচ্ছে যে, এই নগরে মানুষের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অধীনে নানা স্থানীয় সরকারি সংস্থা বা সরকারের বিভাগ বা দপ্তর এদের কারোই কি কোনো দায়িত্ব নেই মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের?
আর আইন শৃঙ্খলার রক্ষার জন্য যে পুলিশ রয়েছে, ওদের কি দায়িত্ব শুধু ঘটনাটি নথিভুক্ত করা? দায়ী ব্যক্তি খুঁজে বের করার কি কোনো দায়িত্ব পুলিশের নেই? অথচ এইরকম তো হওয়ার কথা নয়, রাষ্ট্র এবং সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়ার কথা মানুষের প্রাণ রক্ষা করা। মানুষের প্রাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে?
অথচ রাষ্ট্রের যে তিনটি অঙ্গের কথা আমরা বলি—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আর নির্বাহী বিভাগ—প্রতিটি বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জীবন নিরাপদ, স্বচ্ছন্দ, স্বাস্থ্যবান ও আনন্দময় করা। প্রতিটি রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ, পররাষ্ট্র নীতি, মিলিটারি, যুদ্ধ, রাজনীতি, আইন, আদালত যা কিছু আছে—ওদের কাজ কী? কার জন্যে এরা কাজ করে? নাগরিকদের জন্য—প্রতিটা নাগরিকের জন্য।
কখনো রাস্তায় নির্মাণাধীন ফুটওভার ব্রিজ ভেঙে পড়ে বা কখনো নির্মাণাধীন উড়াল সড়ক ভেঙে পড়ে। কিন্তু এই পর্যন্ত এইরকম ঘটে যাওয়া মৃত্যুর জন্য কেউ শাস্তি পায়নি বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি বা কাউকে ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।
সবকিছুর মূল লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকদের জীবন আরও উন্নত, আরও নিরাপদ, আরও আনন্দময় করা। এই জন্য দেখবেন প্রতিটি আধুনিক ও অগ্রসর রাষ্ট্রে কখনো কখনো কেবল একজন নাগরিকের জীবন রক্ষার জন্য গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অথবা দেখবেন নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করে বা বিপদগ্রস্ত করে এই রকম একটি ঘটনা নিবারণের জন্য প্রায় যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে ফেলে। কেননা রাষ্ট্রের তো মূল কাজই নাগরিকদের জীবন রক্ষা করা। নাগরিকদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে? কিছু না।
আরও পড়ুন
আমাদের এই প্রিয় রাষ্ট্রটি আমরা স্থাপন করেছি পঞ্চাশ বছরের চেয়ে বেশি হয়ে গছে। অনেক অগ্রসরও হয়েছি আমরা। প্রমত্তা পদ্মার ওপর ব্রিজ গেঁথেছি, আকাশে রকেট উড়িয়েছি, শূন্যের ওপর সড়ক বেঁধেছি এইরকম কত কী! আর কতরকম আইন যে আমাদের রয়েছে! মুখের কথা পছন্দ না হলে ধরে নিয়ে জেলে পুড়ে দেওয়া যায় এমন আইন আছে আমাদের দেশে এবং এর ক্ষেত্রে পুলিশ যে কী তৎপর থাকে!
অথচ এই পঞ্চাশের অধিক বছর সময়ে আমরা এমন একটা আইনি কাঠামো তৈরি করতে পারিনি যা দিয়ে নির্মাণাধীন বা নির্মিত বড় বড় স্থাপনাগুলোর মালিকদের বাধ্য করা যায়, যেন ওরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার শঙ্কা নিবারণে। এমন কোনো আইনি কাঠামো আমাদের নেই যাতে করে দুর্ঘটনায় কোনো নাগরিকের মৃত্যু হলে সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থা যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বা তার পরিবারকে।
....অথচ রাষ্ট্রের যে তিনটি অঙ্গের কথা আমরা বলি—আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আর নির্বাহী বিভাগ—প্রতিটি বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জীবন নিরাপদ, স্বচ্ছন্দ, স্বাস্থ্যবান ও আনন্দময় করা।
আমাদের যে পুলিশ বা অন্যান্য সংস্থাগুলো এইসব ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের যেন কখনোই শনাক্ত করতেই পারে না। সড়কে মাথার উপর ইট পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন তরুণ সম্ভাবনাময় কর্মকর্তা প্রাণ হারালেন—এইরকম একটা ঘটনা পশ্চিমের কোনো দেশে ঘটলে আজ তোলপাড় হয়ে যেত সংবাদমাধ্যম, আইন পরিষদ, স্থানীয় সরকার, পুলিশ সরার মধ্যে।
উন্নত দেশসমূহের কথা বাদ দিলাম, এই যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব যাদের অনেক সময়ে মনে হয় গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই—ওদের দেশেও এইরকম ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীর পরিবারকে আজীবন নিশ্চিন্তে চলার মতো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হতো।
আরও পড়ুন
আমেরিকায় এম্বুলেন্সের পেছনে ধাওয়া করা একদল উকিল আছেন, রাস্তায় যদি কেউ উল্টে পড়ে পায়ের আঙুল ভেঙে ফেলেন তাকে গিয়ে উসকে দেন মামলা করার জন্য। সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেই মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ। কেননা নগর সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখা তো সিটি কর্পোরেশনেরই কাজ, একজন নাগরিক যদি আঘাতপ্রাপ্ত হন বা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার মানে হচ্ছে যে নগর ব্যর্থ। আমাদের এখানে উল্টো বিধান।
আপনাদের মনে আছে, রানা প্লাজার কথা বা তাজরিনের কথা বা তেজগাঁওয়ে ভবন ধসের কথা। এইসব ঘটনায় তো সব জানা ছিল, কার অবহেলায় এতোগুলো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তারপরেও কি সেইসব ব্যক্তির কোনো শাস্তি হয়েছে? যারা প্রাণ হারিয়েছেন ওদের পরিবার উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছে? না।
সরকার বা নানারকম সংস্থা সামান্য কিছু টাকা দেয়, দয়া করে একটু চিকিৎসা দেয়—ভাবখানা যেন বিশাল দয়া করছে। এটা তো নাগরিকদের প্রাপ্য। নাগরিকদের অধিকার আছে—জীবন ধারণের অধিকার, রাইট টু লাইফ। সেই অধিকার খর্ব করলে রাষ্ট্রের সব বিভাগ যারাই সংশ্লিষ্ট, সবাই দায়ী, ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় সরকার দায়ী। আমরা এইসব নিশ্চিত করতে পেরেছি? পারিনি। ইচ্ছা করেই করিনি, মানুষের প্রাণের চেয়ে পুঁজি বা ব্যবসা বাণিজ্য আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এই যে দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপু প্রাণ হারালেন, তার পরিবার, শিশু সন্তানটির কাছে আমরা সকলেই দায়ী থাকবো। ওর মায়ের জীবন নিরাপদ করতে পারিনি আর ওর মায়ের হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদেরও কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে পারিনি। এই দায় নিয়ে আমরা ঘুমাবো কীভাবে?
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট