ছবি : সংগৃহীত

চলচ্চিত্র সবসময় জীবন থেকে নেওয়া স্টোরি দিয়ে তৈরি হয়। সাথে কিছু সিনেমাটিক উপাদান থাকে যা অতি মুনাফা লাভের পণ্যে পরিণত করে। সেইখানে মশলা থাকে বেশি আর জীবনের গল্প থাকে স্বল্প। মনে রাখা জরুরি, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সেইখানে কত শতাংশ জীবন থাকে আর কত শতাংশ চলচ্চিত্র থাকে তার ওপর ভিত্তি করেই দর্শকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি হয়।

সম্প্রতি ‘টুয়েলভথ ফেল’ চলচ্চিত্রের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে ‘চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা’র এই তত্ত্ব প্রযোজ্য। কেননা, যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন তারা জানেন যে, ‘টুয়েলভথ ফেল’-এ জীবনের গল্প আছে, জীবনের যুদ্ধ আছে এবং আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় ঠাসা নিদারুণ জীবন আছে। ফলে, এটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে খুব সহজেই।

হাল আমলে বলিউডের চলচ্চিত্র হ্যাভি-আর্মড ভায়োলেন্স, সুড়সুড়ি দেওয়া সেক্সিজম, অপ্রয়োজনীয় আইটেম সং, চকলেট চেহারার স্টারডম, বেহুদা বডি-শো, কম্পিউটার ইফেক্টের দুর্দান্ত ব্যবহার, কর্পোরেট কালচারের বেশুমার প্রদর্শনী এবং আপার ক্লাসের চকচকে উপস্থাপনা যখন জনপ্রিয়তা এবং বাণিজ্যিক সাফল্যের মাপাকাঠি হিসেবে রীতিমতো স্ট্যাবলিশ করে ফেলেছে, সেইখানে ‘টুয়েলভথ ফেল’ একটি বিপ্লব; একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ।

তাই, ‘টুয়েলভথ ফেল’ একাধারে জনপ্রিয়তা এবং ব্যবসা সফলতার প্রতিষ্ঠিত সূত্রকে যেমন চ্যালেঞ্জ করে অন্যদিকে মশলাবিহীন মুভিও যে দর্শকপ্রিয় ও বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে পারে তা প্রমাণ করেছে। পাশাপাশি, চকলেট-মার্কা স্টারডমের বাইরে সাবঅর্ল্টান লুক নিয়েও যে ভালো, গুণগত মানসম্পন্ন এবং উচ্চমার্গের চলচ্চিত্র হতে পারে, তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

চলচ্চিত্রের স্টোরি লাইন এইরকম—মনোজ ভারতের চাম্বল গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কলেজ ফেল করা এক তরুণ। চেষ্টা, অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম, হার না-মানার মানসিকতা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর তীব্র কমিটমেন্ট এবং আপসহীন মনোবলের কারণে মনোজের স্বপ্ন পূরণ হওয়া তথা আইপিএস অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার গল্প।

তার এই যাত্রায় হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানুষের গল্পে সাজানো চলচ্চিত্র যেখানে মনোজের দাদি, তার বাবা-মা, একজন পুলিশ অফিসার, তার বন্ধু পান্ডে, বন্ধু-বড়ভাই গৌরী ভাইয়া এবং প্রেমিকা শ্রদ্ধার অবদানকে দারুণ মুনশিয়ানায় গাঁথা হয়েছে।

যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন তারা জানেন যে, ‘টুয়েলভথ ফেল’-এ জীবনের গল্প আছে, জীবনের যুদ্ধ আছে এবং আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় ঠাসা নিদারুণ জীবন আছে। ফলে, এটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে খুব সহজেই।

পুরো গল্পটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের চলচ্চিত্র কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনাকে ধরে রাখবে টান টান উত্তেজনায় কেননা চলচ্চিত্রের কোনো না কোনো জায়গায় আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন। কারণ সবার জীবনের কোনো না কোনো পর্বে মনোজের বাবা-মার মতো একজন বাবা অথবা মা ছিল, একজন দাদি ছিল, কিংবা পান্ডের মতো বন্ধু ছিল, গৌরী ভাইয়ার মতো বড়ভাই ছিল কিংবা শ্রদ্ধার মতো প্রেমিকা ছিল। তাছাড়া, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের গল্পই মোটাদাগে কষ্ট করে, প্রচুর পরিশ্রম করে সফল হওয়ার গল্প।

কোনো সফলতাই বিনা পরিশ্রমে আসে না। ফলে, মনোজের ভেতর আমরা নিজেকে আবিষ্কার করি। কেননা এই চলচ্চিত্র দেখিয়েছে শুধু পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে বারবার হেরে গেলেও ‘রিস্টার্ট’ করে আপনি বারবার ফিরে আসবেন। যে ‘রিস্টার্ট’ করতে শিখে যায়, তার সফলতা নিশ্চিত। এটাই চলচ্চিত্রের মূল বক্তব্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে কেন এত আলোচিত হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মনোজের আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন এবং সাধনা বাংলাদেশে অনেক তরুণের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন এবং সাধনার সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে। তাই, ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভির ‘মনোজ’ ও ‘শ্রদ্ধা’ বাংলাদেশের শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের এখন ‘হাউজহোল্ড নেইম’। আর গ্রাম ও মফস্বলের স্বপ্নবান তরুণের অন্তহীন অনুপ্রেরণা যা তাদের মনোবাঞ্ছাকে বাড়িয়ে দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগাচ্ছে।

প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে, বৈধ ক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি, জীবনের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা’র ভাবনা বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন তরুণের মধ্যে ‘সরকারি আমলা’ (আইপিএস অফিসার একজন পুলিশ হলেও সরকারি কর্মকর্তার পদকই [বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার] কেন্দ্রীয় মনোযোগ) হওয়ার যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছে, ‘টুয়েলভথ ফেল’ স্বপ্নের সেই আগুনে রীতিমত ‘ঘি’ ঢেলেছে।

চলচ্চিত্রটি তাই অনেকের জীবনের সাথে ‘প্রশ্নের কমন পড়া’র মতো কমন পড়েছে। অন্তত স্বপ্নের সাথে কমন পড়েছে এটা বলা যায়। ফলে, ‘টুয়েলভথ ফেল’ বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং তুমুল আলোচনার খোরাক তৈরি করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে কেন এত আলোচিত হচ্ছে? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মনোজের আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন এবং সাধনা বাংলাদেশে অনেক তরুণের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন এবং সাধনার সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে।

‘টুয়েলভথ ফেল’ চলচ্চিত্রের সফলতার কারণ মোটাদাগে ছয়টি—(১) এটি একটি নিম্নবিত্ত তথা সমাজের অতি দরিদ্র পরিবারের এক তরুণের সংগ্রামের কাহিনি যার সাথে বাংলাদেশে অসংখ্য তরুণের জীবনের দারুণ মিল আছে। এমনকি যারা সফল হয়েছেন তাদের সফলতার গল্প অনেকটা ‘টুয়েলভথ ফেল’ এর স্টোরি লাইনের সাথে মিলে যায়। ফলে, ‘টুয়েলভথ ফেল’ আমাদের অনেকেরই জীবনের গল্প।

(২) একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার হওয়া এখন অনেক শিক্ষার্থীর ‘এইম ইন লাইফ’ যা মনোজ কুমারের আইপিএস অফিসার হওয়ার সাধনা, অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণের আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করছে এবং তুমুলভাবে প্রাণিত করছে।

(৩) ‘টুয়েলভথ ফেল’ এ মনোজের বাবা ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে এবং প্রকাশ্যে সাহসের সাথে প্রতিবাদ করছে যা মনোজকে দারুণভাবে প্রাণিত করেছে। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজে বিদ্যমান ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী শ্রেণি।

সমাজে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণেই এদের অনেকেই যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোয় তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই, ‘চিটিং ছেড়ে দেওয়ার’ গল্প এবং তার হাত ধরে আসা সফলতা সমাজে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ প্রজন্মকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।

(৪) ‘রিস্টার্ট’-এর ধারণা ‘টুয়েলভথ ফেল’ চলচ্চিত্রে দারুণভাবে প্রতিভাত হয়েছে যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হার না মানার মানসিকতা তৈরি করেছে। ‘থ্রি ইডিয়টস’ চলচ্চিত্রে ‘অল ইজ ওয়েল’ যেমন বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভিতেও ‘রিস্টার্ট’ হার না মানার দারুণ মোটিভেশনের স্পিরিট জন্ম দিচ্ছে।

(৫) প্রবাদ আছে ‘ফেইলিয়র ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’। ফেল করাকে সমাজ সবসময় তিরস্কার করে। কিন্তু ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভি দেখিয়েছে সত্যিই ‘ফেইলিয়র ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’। ফলে, এই চলচ্চিত্র অসংখ্য তরুণের জন্য দারুণ জীবনীশক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে।

(৬) ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভির নায়িকা শ্রদ্ধাও দর্শকের দারুণ শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। কেননা, বাংলাদেশের লাখো ক্যারিয়ার-সিকিং তরুণের স্বপ্ন-প্রেমিকা শ্রদ্ধার চরিত্রে হাজির হয়েছে। মনোজের সফলতার পেছনে যেমন শ্রদ্ধার বিরাট ভূমিকা আছে তেমনি ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভির সফলতার পেছনেও শ্রদ্ধার বিরাট ভূমিকা আছে।

কিন্তু আমি যেভাবে দেখতে চাই, বাংলাদেশের সমাজের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অসমতা, ক্ষমতার অসম সম্পর্ক এবং সমাজ কাঠামোর বৈষম্যমূলক চরিত্র নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যেভাবে ক্রমান্বয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রান্তিকায়ন প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান হারে প্রান্তিক করে তুলছে সেই প্রান্তিক অবস্থান থেকে বের হয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের মতো দেশে সবচেয়ে কার্যকর প্রক্রিয়া হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হওয়া।

ভারতে আইপিএস অফিসার কিংবা বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন উৎপাদনের পেছনে খানিকটা ঔপনিবেশিক কারণও রয়েছে। ‘লাট-সাহেব’ বা ‘বড় সাহেব’ হওয়ার স্বপ্ন আমাদের কলোনিয়াল মনস্তত্ত্ব।

তথাপি অসম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাজ কাঠামোয় বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে স্বপ্ন তরুণ প্রজন্ম লালন করছে তার মূলে খুবই কার্যকর এবং জুতসই প্রেরণা ও প্রণোদনা দিয়েছে ‘টুয়েলভথ ফেল’ মুভি। ফলে, ‘টুয়েলভথ ফেল’ বাংলাদেশের ‘ভার্চুয়াল’ ও ‘একচুয়াল’ ওয়ার্ল্ডে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মাঝখান দিয়ে লাভ হয়েছে শহরকেন্দ্রিক ‘বিসিএস কোচিং সেন্টার’ গুলোর। একে বলে ‘কো-ল্যাটারেল বেনেফিট্স’।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়