বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরায় পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা
স্বাধীনতা অর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছে দেশ। ময়দানে চলছে তুমুল লড়াই। বাংলায় পাকিস্তানিরা হচ্ছে নাস্তানাবুদ। পালাবার পথ পাচ্ছে না। শত্রুমুক্ত হচ্ছে একের পর এক অঞ্চল। যার কারণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার মহাসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা, বিজয়ের রক্তিম সূর্যের জন্য দিচ্ছেন প্রাণ, তার কিন্তু এসবের কিছুই জানার সুযোগ ছিল না।
এমনকি একাধিক দেশ যখন স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে, সেই সংবাদও পৌঁছায়নি তার কাছে। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। হানাদারদের জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন কাটছিল বঙ্গবন্ধুর। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে চলছিল প্রহসনের বিচার।
বিজ্ঞাপন
সেই বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে জান্তা সরকার। কারাগারেই খোঁড়া হয় তার জন্য কবর। কিন্তু তাতে বিচলিত হননি তিনি। হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ছিলেন প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল, তার মৃত্যু হলেও বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধ কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। একদিন না একদিন স্বাধীনতা আসবেই। তাই স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন।
সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর থেকে বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে থাকে বাংলার মানুষ। একের পর এক অধিকার বঞ্চনায় প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, অসীম সাহস এবং সর্বোপরি গণমানুষের পক্ষে অবস্থানের ফলে তিনি হয়ে ওঠেন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কারিগর।
আরও পড়ুন
১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। এরপর থেকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চালিয়ে যেতে থাকেন স্বাধিকারের আন্দোলন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। সত্তরের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্জন করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে জান্তা সরকার। কোনো বাঙালি হবে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তা মেনে নিতে পারেনি শাসকগোষ্ঠী।
শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে সাতই মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এইদিন কৌশলে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন জাতিকে। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে পাকিস্তানিরা। বাঙালিদের শায়েস্তা করতে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে তারা। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতা।
গ্রেফতারের পর সামরিক জিপে করে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে। পরদিন তাকে ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে স্থানান্তর করা হয়, সেইখান থেকে কঠোর গোপনীয়তায় বিমানে করে পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যাওয়া হয় জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে।
সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর থেকে বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে থাকে বাংলার মানুষ। একের পর এক অধিকার বঞ্চনায় প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুকে আটক করে স্বাধীনতা যুদ্ধকে গতিহীন করতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা। তারা ভেবেছিল তাকে বন্দি রাখলে নেতাবিহীন বাঙালি পৌঁছতে পারবে না লক্ষ্যে। কিন্তু তার প্রেরণার শক্তি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না পাকিস্তানিদের। কোটি বাঙালির মধ্যে তিনি যে দ্রোহী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন এবং তা যে তার অনুপস্থিতিতের বন্দরে পৌঁছে দেবে স্বাধীনতার তরি তা ছিল তাদের ভাবনারও অতীত।
আটক মুজিবকে নিয়ে পাকিস্তানিদের ভয়ের অন্ত ছিল না। তাই একজন রাজবন্দি হিসেবে যে মর্যাদা দেওয়ার কথা ছিল তাকে তার ধারে কাছেও ছিল না জান্তা সরকার। উল্টো তাকে লাহোরর ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রীষ্মে ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার এলাকার কারাগারের অন্ধকার সেলে আলো বাতাসহীন অবস্থায় রেখে বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে চেয়েছিল তারা।
আরও পড়ুন
তাদের ধারণা ছিল, এর মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবেন তিনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসীম ধৈর্য আর মনোবলের কারণে তাদের চক্রান্ত সফল হয়নি। কারাগারের নির্জনতার সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় থাকলেও এমন বিরূপ পরিস্থিতি তিনি মোকাবিলা করেননি আগে কখনো। কারণ কারও সাথে কথা বলা এবং সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না তার।
বঙ্গবন্ধুকে কোথায় আটক রাখা হয়েছে, তিনি কেমন আছেন, কী করা হচ্ছে তার সাথে এসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে হায়নারা। আটকের ৩ মাস ২৪ দিন পর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খবর জানতে পারে বিশ্ববাসী। এর ২০ দিন পর সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত একটি সংবাদে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ‘মুজিবকে কালকেই আমি গুলি করছি না’—শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে তিনি এও বলেন যে, আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সেই বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারবেন না।
১৯ জুলাই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর আসন্ন বিচারের বার্তা প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মোট ১২টি অভিযোগ আনা হয়। এরমধ্যে ছয়টি অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এক তরফা এই বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতে প্রবীণ আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ প্রদান করে সরকার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন বুঝতে পারেন, এটা বিচার নয়, শুধুই প্রহসন তখন বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এবং তার পক্ষে কৌঁসুলি নিয়োগে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য থেকে সেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা কিছুটা জানতে পারি। ডেভিড ফ্রস্টকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোনো দাম নেই, দেখলাম এই হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম—জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এই হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এই বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’
৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। বিচার প্রক্রিয়া শেষে মিয়ানওয়ালি জেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইখানে দণ্ডাদেশ কার্যকরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার সেলের পাশেই খোঁড়া হয় কবর। তিনবার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ভুট্টোর পরামর্শে তা স্থগিত করেন তিনি।
আরও পড়ুন
১৬ ডিসেম্বর পরাজয়ের পর ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই সময় তিনি তার একটি ইচ্ছে পূরণের আবেদন আবেদন করে বলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।’
ভুট্টো বুঝতে পারেন জেলখানায় হত্যা করা হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে। সেই কারণে মিয়ানওয়ালি জেল সুপার হাবীব আলির বাসভবনে নিয়ে রাখা হয় তাকে। পরবর্তীতে সেইখান থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে সিহালা পুলিশ রেস্ট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এই রেস্ট হাউজের দূরত্ব ছিল প্রায় ২৩ কিলোমিটার। এখানেই ভুট্টো এসে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সাথে।
৭ তারিখ রাত ২টার দিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ছাড়ে বিমান। ভুট্টো নিজে বিমানবন্দরে এসে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, ‘বিমানটি ননস্টপ লন্ডন যাবে। কাউকে জানানো হবে না যে, আপনি বিমানে আছেন। লন্ডন বিমানবন্দরে নামার আধঘণ্টা আগে জানানো হবে বিমানে আপনি আছেন।’
৮ জানুয়ারি ভোরে পিআইএর বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভোরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা কর্মকর্তা পিঁটার লেংলী টেলিফোনে মুক্তিযুদ্ধের স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শেখ মান্নানকে বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসার সংবাদ জানান। ব্রিটিশ সরকারের ফরেন এ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সাউথ এশিয়া বিভাগের মন্ত্রী ইয়ার সাদারল্যান্ড ভিআইপি লাউঞ্জে অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধুকে।
‘মুজিবকে কালকেই আমি গুলি করছি না’—শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে তিনি এও বলেন যে, আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কী হবে, সেই বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারবেন না।
বিমানবন্দর থেকে তাকে লন্ডনের বিখ্যাত ক্লারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার বাঙালি তাকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন হোটেলে। হোটেলের জানালা দিয়ে বঙ্গবন্ধু অভিবাদন জানান হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান জনতাকে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া বিশেষ বিমান ‘কমোটে’ করে স্বদেশের পথে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে দিল্লিতে অবতরণ করে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি। দেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে দিল্লি বিমানবন্দরে মুক্তির মহানায়ককে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এই উপলক্ষে আয়োজন করা হয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের।
সেইখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন স্বাধীনতার স্থপতি। বক্তব্য রাখেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তার শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও তার আত্মাকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেনি। তার প্রেরণায় বাংলাদেশের মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। ...এই যুদ্ধের সময় আমরা ভারতের পক্ষ থেকে তাদের জন্য তিনটি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এক. যে শরণার্থীরা ভারতে আছে তারা সময় হলে ফিরে যাবে। দুই. আমরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করবো ও বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াবো তিন. শেখ সাহেবকে আমরা দ্রুত জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবো। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রেখেছি।’
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় আমাদের স্বাধীনতার জন্য অকুণ্ঠ সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান এবং আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সার্বক্ষণিক তাদের পাশে থাকার জন্য ভারত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষদের দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের (কারাকক্ষ) মধ্যে বন্দি ছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন জায়গা নাই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার কাছে এবং তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এরপর বঙ্গবন্ধু রওনা হন স্বাধীন দেশের পথে। সেইদিন দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে জাতির জনককে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনের নির্ভরযোগ্য ভাষ্য আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন তোফায়েল আহমদের কাছ থেকে—“সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে চারদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে। ঢাকায় যখন সাজ সাজ রব। ...দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা, আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদেও নেতারা ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
তা এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রু নদী আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে।
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ অপেক্ষমাণ জনতার মুহুর্মুহু করতালি আর ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে মুখ মুছলেন। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দুই চোখ তখনো অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সেই অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা।
হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ তিরি বলেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদের একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।”
এখানেও বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নাই যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বলো শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে।’
আরও পড়ুন
স্বপ্নের মৃত্যু নেই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। তিনিই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে উন্নয়নের জন্য ঘরে ঘরে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন করছেন তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। পিতার অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। বাংলাদেশকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসতে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাই শেখ হাসিনার চলার পথের পাথেয়।
জাতির জনককে ৭৫-এর পনের আগস্ট হত্যা করা হলেও তার স্বপ্নকে, তার চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি ঘাতকরা। তাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার তাদের নীলনকশাও বাস্তবায়ন হয়নি। একটা সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা অসম্ভব, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো অলীক মনে হলেও আজকের বাস্তবতায় সেই অসম্ভব হয়েছে সম্ভব আর অলীক হয়েছে বাস্তব।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যেমন পূর্ণতা পেয়েছিল, তেমনই তার দেখানো পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ আওয়ামী লীগ যে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে নতুন করে রাষ্ট্র পরিচালনার ম্যান্ডেট পেয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। তাই আজও পথ হারায়নি বাংলাদেশ।
অপূর্ব শর্মা ।। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক