করোনা সংক্রমণ
দ্বিতীয় ঢেউয়ের দায় কার?
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণও কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতায় ভয় পেতে শুরু করেছে। শীতকালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা থাকলেও এই ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিল। ফলে, জনগণের মধ্যে সুরক্ষা নির্দেশিকাগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা দেয়। আমরা প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে লোকজনকে অবাধে ঘরের বাইরে ঘুরতে দেখেছি এবং হাজার হাজার মানুষকে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে এরা গত কয়েক মাস ধরে বাড়িতে থাকতে থাকতে হতাশ হয়ে পড়েছেন। সুতরাং, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারা জীবন উপভোগ করতে শুরু করেছে।
সংক্রমণের নিম্নহারের পাশাপাশি টিকা গ্রহণের সুযোগ জনগণকে কোভিড-১৯ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার সুরক্ষা সর্তকতা অনুসরণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলেছে। এক শ্রেণির শিক্ষিত জনগণ যারা কোভিড-১৯ প্রটোকল কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন, তারাও ভ্যাকসিন গ্রহণের পর থেকে সুরক্ষার সর্তকতা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রদর্শন করেছেন। ফলে, প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেন (যেটি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল) দেশে সংক্রমণের হারকে অবিশ্বাস্য তীব্রতায় বৃদ্ধি করেছে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে চিহ্নিত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেনগুলো পূর্বের স্ট্রেনগুলোর তুলনায় ৭০ গুণ বেশি হারে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখলেও এর থেকে মৃত্যুহার খুব বেশি নয়। কিন্তু, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা জানতে পারছি যে, এই নতুন স্ট্রেনে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে, পূর্বের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি। এই অবস্থায়, জনগণ যদি তাদের আচরণ পরিবর্তন না করে তাহলে সামনে আমাদের জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
জনগণের মধ্যে এমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, তারা বিশ্বাস করে করোনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। ফলে, কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ চলাচল করছে। রাস্তায় জনগণের চলাচল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে আমাদের দেশের খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা মহামারির ভয়াবহতা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা রয়েছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন মৃত্যুহার এবং রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সকলের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে এই ভেবে যে, আমরা এই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করব? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলা, ঘনঘন হাত ধোয়া এবং অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার মতো নির্দেশিকাগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে অনীহা দেখা দিয়েছে। জনগণের মধ্যে এমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, তারা বিশ্বাস করে করোনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। ফলে, কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ চলাচল করছে। রাস্তায় জনগণের চলাচল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে আমাদের দেশের খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনা মহামারির ভয়াবহতা সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা রয়েছে। জনগণের এই ধরনের আচরণ কখনোই কাম্য নয়। এই আচরণ শুধু একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না, বরং সমাজের অন্যান্য মানুষকেও এই মারাত্মক ভাইরাসের সংক্রমণের মুখোমুখি করছে।
করোনা মহামারির প্রথম পর্যায়ে সরকার এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হিসেবে অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। জনগণকে বাড়ির বাইরে মাস্ক পরতে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। সরকারি অফিসে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি বাস্তবায়ন করেছে। রাস্তাঘাটে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে যদিও সবক্ষেত্রেই এক ধরনের ঢিলেঢালাভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মোবাইল কোর্ট রাস্তায় কাজ করলেও সেগুলো ছিল শহরকেন্দ্রিক। মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে খুবই নগণ্য ছিল। ফলে, গ্রামের জনগণের মধ্যে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে কোনো ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি।
রাস্তাঘাটে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে যদিও সবক্ষেত্রেই এক ধরনের ঢিলেঢালাভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মোবাইল কোর্ট রাস্তায় কাজ করলেও সেগুলো ছিল শহরকেন্দ্রিক। মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে খুবই নগণ্য ছিল। ফলে, গ্রামের জনগণের মধ্যে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে কোনো ধরনের সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি।
গত ১৪ তারিখ থেকে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে পুনরায়। যদিও লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্টস এবং কলকারখানা খুলে রাখার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক—এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবুও আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে যে সরকারি নির্দেশনা মেনে লকডাউন সফল না করতে পারলে এই মরণঘাতী ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তি এবং দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দেবে। লকডাউনেরর মতো কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে কারণ অর্থনীতির চাকা সচল না থাকলে দেশে আরেক ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। এছাড়াও দেশের জনগণের একটি বিশাল অংশ খেটে খাওয়া মানুষ। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হলো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
করোনার মতো ভাইরাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে জনগণ যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে সুরক্ষা নির্দেশনাগুলো মেনে না চলে সেই ক্ষেত্রে জনগণকে বাধ্য করা সরকারের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। আইন লঙ্ঘন করা কিংবা আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা দেশের জনগণের একটি বিশাল অংশের জন্য স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, এই শ্রেণির জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই।
করোনা মহামারির মতো বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য সরকারই শুধুমাত্র সকল কিছুর জন্য দায়বদ্ধ থাকবে এই ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে জনগণের উচিত সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে চলা এবং ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং দেশকে রক্ষা করা।
ড. প্রণব কুমার পান্ডে ।। অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়