বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন ও বিএনপির নির্বাচন বিরোধী প্রচারণা
ভোট ঠেকাতে বিএনপির ডাকা হরতালের আগের রাতে (৫ জানুয়ারি ২০২৪) রাজধানীর গোপীবাগে আগুনে পুড়ল বেনাপোল এক্সপ্রেস। এই ঘটনায় অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন দগ্ধ হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে ঢাকার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেল কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম।
ট্রেনে আগুন লাগার সময় জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন একজন যাত্রী। হাত বাড়িয়েছিলেন সাহায্যের জন্য, বের হতে পারেননি। তার অর্ধেক শরীর ট্রেনের জানালার বাইরের, অর্ধেকটা ভেতরে। শত শত মানুষের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হলেন যাত্রী।
বিজ্ঞাপন
৭ তারিখ নির্বাচন আর ৫ তারিখ বিএনপির ডাকা হরতালে এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবাই বিস্মিত, হতবাক। কেন এমন হয়? বিএনপি-জামায়াত কেন এমন করে?
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সারাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর নির্বিচারে সহিংসতা চালিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করেছে নজিরবিহীনভাবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে পেট্রোল বোমা ও অগ্নিসন্ত্রাস ঘটিয়ে দলটি ৪০০-এর বেশি ভোট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত প্রাইমারি স্কুল অগ্নিদগ্ধ করেছে।
২০১৩-১৫ সালে বিএনপি জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে ৫০০ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান, ৩৫০০ মানুষ আহত হন এবং ৮১৩ যানবাহন পুড়ে যায়। ২০২৪ সালের নির্বাচন বানচালের জন্য কিছুদিন আগেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে বিএনপি, এতে মায়ের বুকে থাকা শিশুসহ আগুনে পুড়ে চারজন মারা যান। এছাড়া ২৭০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয় ২০২৩ এর ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত।
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখের ঘটনাও আমাদের বিস্মিত করেছে। কেন রাজনৈতিক সহিংসতার বলী হয় সাধারণ মানুষ?
আরও পড়ুন
সাধারণ জনগণকে ভোট না দেওয়ার জন্য নির্বাচন বিরোধী প্রচারণা ও অগ্নিসন্ত্রাস চালাচ্ছে বিএনপি। ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে টানা গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ করেছে। ৬ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে ৮ জানুয়ারি সকাল ৬টা পর্যন্ত (৪৮ ঘণ্টা) দেশব্যাপী বিএনপির ডাকা হরতালের কর্মসূচি দিয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও ভোটদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন হরতাল কর্মসূচিসহ ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির পাশাপাশি আন্দোলনে অন্যান্য মিত্র দলগুলোও অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সারাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর নির্বিচারে সহিংসতা চালিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করেছে....
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন মূল ভিত্তি এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনীতি চর্চার মূল লক্ষ্য। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন জনগণের স্বাধীনভাবে এবং স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার এবং ভোটপ্রয়োগ করার অধিকার থাকে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্ত যেকোনো রাজনৈতিক দল নিতেই পারে কিন্তু নির্বাচন বর্জনের জন্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, জনগণকে সহিংসতার ভয় দেখানো বা নির্বাচনের দিন হরতাল দিয়ে জনগণের ভোট অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করার অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।
বিএনপির নির্বাচন বিরোধী প্রচারণা ও হরতালের ঘোষণা গণতন্ত্রের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার প্রক্রিয়া হিসেবে একটি বড় ধরনের অপরাধ, এটি ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।
আরও পড়ুন
নির্বাচনে ভোটাররাই মূল চালিকা শক্তি এবং ভোটের পুরো আয়োজনটাই ভোটারদের জন্য। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান ভোটাধিকার রয়েছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেওয়ার অধিকারও নাগরিক অধিকার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবির মতে, গণতন্ত্রে ভোটাধিকার অতি মূল্যবান অধিকার এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও। নাগরিকের এই অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ধরা হয়। অনেক দেশে ভোট দেওয়া নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক।
অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে নাগরিকদের কেউ ভোট দিতে না গেলে তাদের জরিমানা করা হয়। যদি কেউ ভোট দিতে আগ্রহী না হন তবে আগে থেকেই তা নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। আমাদের দেশে এই ধরনের কোনো বিধান নেই, ফলে ভোট দেওয়া-না দেওয়া ভোটারের নিজস্ব ইচ্ছা।
দণ্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ১৭১ (ক) অনুসারে, ভোটাধিকার বলতে একজন ব্যক্তির ভোট দেওয়া কিংবা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার অধিকার বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, ভোট দেওয়া থেকে যেমন কাউকে বিরত রাখার চেষ্টা করা যাবে না, একইভাবে ভোট না দিতে চাইলেও কাউকে জোর করা যাবে না।
বিএনপি-জামায়াতের হরতালের উদ্দেশ্যই থাকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করা...
দণ্ডবিধির ধারা ১৭১ (গ) অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি নির্বাচনী অধিকারের অবাধ বা স্বাধীন প্রয়োগে ইচ্ছাপূর্বক হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের অপরাধে অপরাধী হবে। প্রার্থী বা ভোটার বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির বা সম্পত্তির যদি কেউ অবৈধ ক্ষতি সাধন করার হুমকি দেন তাহলে সেইটিও অনুচিত প্রভাব বলে গণ্য করা হবে।
সুতরাং, ভোট দিতে বা ভোট না দিতে বাধ্য করার জন্য কেউ যদি ভোটারকে কিংবা তার পরিবারের কাউকে হয়রানির হুমকি দেন কিংবা তার সম্পদের ক্ষতিসাধন করতে চান, তবে তা অনুচিত প্রভাবের আওতায় পড়বে।
আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭৪ এর ৭৭ ধারা অনুযায়ী, বলপ্রয়োগের সাহায্যে—কোনো ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগে অসুবিধা সৃষ্টি বা বাধা প্রদান করা বা কোনো ভোটারকে ভোট প্রদান করতে বা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য, প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ করা অপরাধ।
আরও পড়ুন
বিএনপি-জামায়াতের হরতালের উদ্দেশ্যই থাকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করা। ৪৮ ঘণ্টার হরতাল নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই রাখা হয়েছে। বিএনপি- জামায়াতের সহিংসতার রূপ যারা দেখেছেন তারা হরতালের কারণে ভোট দিতে ভয় পেতে পারেন কিংবা নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
হরতাল ডেকে ভোটারদের ভোটদানকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা আইনসঙ্গত নয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে, ভয় ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুৎসাহিত করা অপরাধ।
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তির ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যে সম্পর্ক তা অনুযায়ী, ব্যক্তির ভোটদানের এই মৌলিক অধিকার কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী কোনো অবস্থাতেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে না।
বিএনপি-জামায়াত বা কোনো অপশক্তি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করলে বা অধিকারগুলো প্রয়োগে বাধা দিলে প্রত্যাশা করি রাষ্ট্র কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
ড. ফারজানা মাহমুদ ।। গবেষক ও আইনজীবী