ছবি : সংগৃহীত

শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের পক্ষেই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের থাকার কথা। ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ছিল এভাবে—The US policy on global workers’ rights: Secretary of the US Department of State Antony J Blinken in his speech said those who threaten, intimidate, attack union leaders, labour rights defenders and labour organizations will be held accountable at the Rollout of the Presidential Memorandum on Advancing Worker Empowerment, Rights and High Labour Standards Globally.

১ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকম চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তবে রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে আপিল করার শর্তে চারজনই এক মাসের জন্য জামিন পেয়েছেন।

রায় প্রদানকালে বিচারক বলেছেন, এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস, যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তার বিচার হচ্ছে। অন্যদিকে, রায় ঘোষণার পর সংবাদকর্মীদের ড. ইউনূস বলেছেন, যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম।

ড. ইউনূস নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বহু দশক ধরে কাজ করছেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের  নানা ক্ষেত্রে এখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা দেখছি। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের যে বিচারক ড. ইউনূসের শাস্তির রায় পাঠ করেছেন, তিনিও নারী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার আশা প্রকাশ করে বলেছেন, একদিন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদেও বসবেন কোনো নারী। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের সুফলভোগীরা প্রধানত নারী। গ্রামীণফোন চালুর সময় গ্রামে গ্রামে অনেক নারী মোবাইল ফোনের মালিক হয়েছেন, যা থেকে অনেক অনেক নারী-পুরুষ টাকা দিয়ে ফোন করার সুযোগ পেয়েছেন। এভাবে আয়ের সুযোগ ছিল নারীদের।

এখন অবশ্য, মোবাইল ফোন নিয়ে এই ধরনের ব্যবসার সুযোগ নেই। কেবল ফোন নয়, ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যও তা হাতে রাখার মতো যন্ত্র রয়েছে কোটি কোটি মানুষের হাতে। শেখ হাসিনা দেড় দশক আগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের যে স্লোগান সামনে এনেছিলেন, তার সফল রূপায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মোবাইল ফোন। তিনি মুষ্টিমেয়র হাত থেকে মোবাইল ফোন ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে।

তখন ড. ইউনূস ছিলেন এই মহতী অভিযানে তার সঙ্গী। মনে আছে, তার একটি লেখা, যাতে বলা হয়েছিল—গ্রামে দুই দলের মধ্যে ঝগড়া থেকে মারপিটের অবস্থা। এই সময় এক দরিদ্র নারী হাতে মোবাইল টেলিফোন নিয়ে এসে থামতে বলেন। নইলে তিনি ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে জানাবেন—অকারণে দুই দল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে, আপনি পুলিশ পাঠান জলদি। 

সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে এক যুগের বেশি বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এম সাইফুর রহমান। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন তার ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি’ গ্রন্থে। তবে একইসঙ্গে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মক্ষেত্র অত্যন্ত সীমিত। এই ক্ষেত্রে সরকারের কর্মক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক।’ [কিছু স্মৃতি কিছু কথা, পৃষ্ঠা ২০২]

তিনি লিখেছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক গরিবদের জন্য যে ঋণ দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ দেয় সরকার নিরাপদ বেষ্টনী কর্মসূচির মাধ্যমে। ... বাংলাদেশে শত শত এনজিও মাইক্রোক্রেডিট প্রকল্পে কাজ করে। এই অর্থ দেয় পল্লী কর্মসংস্থান প্রকল্প ও বাংলাদেশ ব্যাংক।’ [কিছু স্মৃতি কিছু কথা, পৃষ্ঠা ২০১-২০২]

সাইফুর রহমান প্রায় দেড় যুগ মন্ত্রী পদে নেই। এই সময়ে সরকারের সামাজিক নিরাপদ বেষ্টনী বা সোশ্যাল সেফটি নেটওয়ার্ক ও ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি বহু গুণ বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে ভাতার পরিমাণ ও সুফলভোগীর সংখ্যা।

গ্রামীণ টেলিকম সংক্রান্ত মামলার পর ‘দৈনিক সংবাদ’ নামের পত্রিকার বার্তা বিভাগের প্রধান মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুজনিত মামলার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কথা বলেছেন এক প্রবীণ সাংবাদিক।

১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। কয়েকদিন আগে নয়া পল্টন এলাকায় তাকে একটি বেসরকারি কোমল পানীয় প্রস্ততকারক কোম্পানির গাড়ি ধাক্কা দেয়। তিনি ট্রাফিক আইন মেনেই রাস্তা অতিক্রম করছিলেন। তাকে প্রকৃতপক্ষে হত্যা করা হয়েছে—এই অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ মামলা হয় এবং আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের রায় দেন।

আপিল বিভাগ পর্যন্ত রায় দিয়েছেন তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পক্ষে। কিন্তু প্রায় তিন যুগ চলে গেছে, মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবার ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি।

কেমন দীর্ঘসূত্রতা? গ্রামীণ টেলিকম সংক্রান্ত মামলার রায় প্রকাশের পর এটা প্রতিষ্ঠিত হলো যে শ্রমিকের পাওনা পরিশোধের জন্য ফৌজদারি মামলা হয়, কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ড হয়। আইন সবার জন্য সমান—এটাও আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হলো। অনির্দিষ্টকাল মামলা চলার ধারা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার তাগিদও স্পষ্ট।

এই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে গ্রহণ করলেই মঙ্গল।

বাংলাদেশের শিল্পায়ন ঘটছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে শ্রমিক ও কর্মচারী সংখ্যা। বঞ্চনার ঘটনাও প্রচুর। যখন তখন ছাঁটাই, উপযুক্ত বেতন না দেওয়া, চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ না করা—কত অভিযোগ। শ্রম আদালতে এর প্রতিকার সম্ভব। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ থাকার পরও অনেকেই এই সুযোগ গ্রহণ করেন না বা করতে পারেন না। গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে শুনেছি—তারা প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হলেও মামলায় যান না। কারণ এক মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে এমনকি জয়ী হলেও ভবিষ্যতের জন্য বিপদে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এক মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা ব্যক্তিকে অন্য মালিকরা চাকরি দিতে নাও চাইতে পারেন। সব রসুনের গোড়া যে এক!

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের ঘটনা হয়ে আছে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনা। এক দশকের বেশি হয়ে গেল, পোশাক খাতের শ্রমিকরা (যাদের বড় অংশই নারী) এখনো বহু ধরনের বঞ্চনা-শোষণের শিকার।

শিল্প মালিকরা বলেন—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডাসহ উন্নত যে সব দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়, তারা সেলাইয়ের জন্য মজুরি দেয় খুব কম। বাংলাদেশসহ অনেক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে তারা সস্তা শ্রমের কারণে পোশাক আমদানি করে। এর পরিমাণ বাড়াতে বললে তারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক না কেনার হুমকি দেয়।

রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর ঢাকায় এক সেমিনারে ড. ইউনূস বাংলাদেশের পোশাক ক্রেতা উন্নত দেশগুলোর বড় বড় বায়ার প্রতিষ্ঠানের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন—‘দয়া করে প্রতিটি শার্টের জন্য ৫০ সেন্ট মূল্য বাড়িয়ে দেন, তাহলেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন অনেক বদলে যাবে। তারা ভালো থাকবে।’

কিন্তু সেই কথায় কেউ কান দেয়নি।

এখন তো শ্রমিকদের বঞ্চিত করার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানই অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত। দেখা যাক, এর প্রতিক্রিয়া কী হয়। এটাও দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের ‘শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার’ আইন কোন পথে চলে। তারা কি ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের ঘোষণা অনুযায়ী শ্রম আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে?  

অজয় দাশগুপ্ত ।। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা