বিবাহ বিচ্ছেদে দেনমোহরের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অধিকার
সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, স্ত্রীর দ্বারা বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হলে যেকোনো অপরিশোধিত দেনমোহর অপ্রদেয় বা প্রদান এড়ানো সম্ভব।
মোহরানার অধিকার একটি বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যে, ধর্ম ও আইন উভয় দ্বারা অপরিশোধিত দেনমোহর/অর্থ প্রদানের বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এমনকি অপরিশোধিত দেনমোহর স্বামীর জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত অথবা তার মৃত্যুর পরেও স্ত্রী কর্তৃক দেনমোহরের অধিকার ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত স্বামীর উপর ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন
স্ত্রীর মোহরানার অধিকার কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা আন-নিসা ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, বিবাহের সময় স্ত্রীকে একটি উপহার বা যৌতুক সদয়ভাবে প্রদান করতে হবে, যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় মওকুফ করে এবং সুরা আল-আহযাব, আয়াত ৫০ এ বলা হয়েছে যে, স্ত্রী তার পূর্ণ যৌতুক বা মোহরানা প্রদানের মাধ্যমে বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এছাড়া বাংলাদেশের প্রযোজ্য আইনে মোহরানার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন ‘মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪’ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে মুসলিম আইনের অধীনে সংঘটিত প্রতিটি বিবাহ বৈধ বিবাহ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য এই আইনের অধীন নিবন্ধিত হতে হবে।
তদনুসারে, ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৯’ এর অধীনে বিবাহ চুক্তি বা নিকাহনামার প্রমিত ফর্ম পূরণ করা আবশ্যক, যেখানে অন্যান্য বিবাহ সংক্রান্ত পূরণীয় বিষয়ের পাশাপাশি মোহরানার বিবরণের বাধ্যতামূলক ক্ষেত্র বা ঘর থাকে, যেমন মোহরানার অর্থের পরিমাণ এবং অর্থপ্রদানের পদ্ধতি।
এছাড়া ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১’ এর ১০ ধারায় বলা হয়েছে যে, স্ত্রী মোহরানা দাবি করা মাত্র মোহরানা পরিশোধ করতে হবে, এবং যদি পরিশোধের পদ্ধতিটি নিকাহনামা বা বিবাহ চুক্তিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা না থাকে সেই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পরিমাণ প্রদেয়।
দেনমোহর তথা অর্থ প্রদান করতে অবহেলা বা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে, ‘পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫’ এর অধীনে যৌতুক বা মোহরানা পুনরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
মোহরানা প্রদানের দুটি জনপ্রিয় এবং ব্যাপকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে যেমন ‘প্রম্পট’ বা ‘মুয়াজ্জাল’ যা বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথেই প্রদেয় হয় তাই কোনো বিরোধ নেই এবং ‘ডিফার্ড’ বা ‘মুয়াজ্জাল’ যা একটি বিলম্বিত দেনমোহর এবং এই ক্ষেত্রে বিরোধ দেখা দেয় যেহেতু সম্পূর্ণ বা আংশিক মোহরানার পরিমাণ বকেয়া থাকে এবং তা সম্মত ভবিষ্যতের তারিখ, বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর জন্য বিবাহ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও প্রদেয় হয়।
আরও পড়ুন
একই কথা কোরআনের সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত ২৩৬, উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিবাহ পরিপূর্ণতা না হলেও বা মোহরানা নির্ধারিত না থাকলেও, স্ত্রীকে তালাকের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা একটি বাধ্যবাধকতা।
অতএব, বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই যে মোহরানা পরিশোধের পদ্ধতিটি ‘ডিফার্ড’ বা বিলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত অঙ্ক হলে বা না হলেও, বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর মোহরানা প্রদানে স্বামীর বাধ্যবাধকতাকে বিলুপ্ত করে না যদিওবা বিচ্ছেদ প্রক্রিয়াটি স্বামী দ্বারা নয় স্ত্রী দ্বারা সূচিত হয়।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারীই কেবল নাগরিক হিসেবে নয়, নারী হিসেবেও বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, যেমন দেনমোহরসহ তাদের বিভিন্ন মৌলিক অধিকারের অস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ বা জ্ঞানের অভাব থাকে।
তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব হচ্ছে এই বিষয়ে আরও সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও কার্যক্রম চালু করা।
এছাড়া সরকার কর্তৃক নিকাহনামার প্রমিত ফর্মের দেনমোহর বিভাগের অধীনে একটি ‘বাধ্যতামূলক’ ধারা বা শর্ত যুক্ত বা সন্নিবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে, যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ উভয় পক্ষের দ্বারা শুরু হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী কর্তৃক দেনমোহর পুনরুদ্ধারের অধিকার ‘নিরঙ্কুশ’ মর্মে উল্লেখ করা প্রয়োজন যাতে আগত ভবিষ্যৎ এ সংক্রান্ত বিষয়ে নানাবিধ সমস্যাসহ পারিবারিক মামলা মোকদ্দমা এড়ানো সম্ভব হয়।
মো. মাহমুদুল ইসলাম শাকিল ।। শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট