ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিকভাবে যেসব প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধিকে অগ্রাধিকার দেয়, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সেইসব রোগের একটি। পরবর্তী মহামারি হতে পারে নিপাহ ভাইরাস। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ধরন কিছুটা করোনাভাইরাসের মতো। তবে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার কোভিডের সংক্রমণে মৃত্যুর হারের তুলনায় অনেকটাই বেশি!

নিপাহ ভাইরাসের আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৪০-৭১ শতাংশ। অন্যদিকে কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার নিপাহর তুলনায় অনেকটাই কম মাত্র ২-৩ শতাংশ।

বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ থাকতে ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩-এ জরুরি সতর্কবার্তা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। কেউ কাঁচা রস খেতে চাইলে তা বিক্রি না করতে গাছি (খেজুরের রস সংগ্রহকারী) বা বিক্রেতাদের প্রতিও অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মালয়েশিয়ার ছোট্ট একটা গ্রাম ‘সুঙ্গাই নিপাহ’। ১৯৯৯ সালে সেই দেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সংক্রমণের উৎস ছিল নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত অসুস্থ শূকর। ড. কো বিং চুয়া ১৯৯৯ সালে শূকরের শরীরে প্রথমবারের মতো নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করেন।

রোগটি যেন মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেই সময় লাখ লাখ শূকর মেরে ফেলা হয়। কারণ, আক্রান্ত শূকর থেকে ভাইরাসটি বাড়ির পোষা কুকুর-বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় ২৬৫ জন মানুষের মধ্যে এনসেফালাইটিস দেখা দেয়, যার মধ্যে মারা যান ১০৫ জন মানুষ।

আক্রান্ত এক রোগীর মস্তিষ্ক থেকে একটি নভেল প্যারামিক্সো ভাইরাস আলাদা করা হয়। লোকটির গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয় নিপাহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ফলভূক বাদুড়ের মধ্যেও শনাক্ত করা হয়েছিল। তা থেকে ধারণা করা হলো, বাদুড় থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মেহেরপুরে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালের পর প্রতিবছরই শীতকালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২২ বছরে ৩৩টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে ৫৭টিতে।

বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল মানুষ খেলেও নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমণ ঝুঁকি গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি...

দেশে দুই দশকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে দেশে এই পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৪০ জন মারা গেছেন। ২০২৩ সালের (মার্চ মাস পর্যন্ত) দেশে ১৪ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনই মারা গেছেন।

বাংলাদেশে দুই দশকের বেশি সময় ধরে যতজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশে শীত মৌসুমে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এই সময় বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত।

শীতের শুরু থেকেই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করেন গাছিরা। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যেও খেজুরের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম প্রিয় খাবার। বাদুড়ের প্রজাতিগুলোর মধ্যে গ্রেটার ইন্ডিয়ান ফ্রুট ব্যাট খেজুরের রস পছন্দ করে।

বাংলাদেশে টেরোপাস মিডিআস গোত্রের বাদুড় নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক আধার। বাদুড় খেজুরের রস বের হওয়ার স্থানটি চেটে রস খায়। কখনো আবার সেখানে প্রস্রাব ও পায়খানা করে। আর বাদুড়ে মুখ দেওয়া খেজুরের রস পানে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

খেজুরের রস ছাড়াও শাক-সবজি, ফলমূলেও বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করে এবং আংশিক খেয়ে থাকে। এসব জিনিস যখন মানুষ ভালো করে পরিষ্কার না করেই কাঁচা খায়, তাও নিপাহ ভাইরাসের অন্যতম একটা উৎস। বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল মানুষ খেলেও নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমণ ঝুঁকি গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি। শহরাঞ্চলে এখন খেজুরের কাঁচা রস নিয়ে উৎসব হচ্ছে। বাংলাদেশে গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, খেজুরের রস একেবারে না খাওয়াটাই যেখানে বাঁচার উপায়, সেইখানে রীতিমতো উৎসব করে রস খাওয়ার আয়োজন করছে নানা প্রতিষ্ঠান। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার তো আছেই।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে খেজুরের রস। আর এই রস ‘নিরাপদে’ সংগ্রহ করা হয় বলেও দাবি বিক্রেতাদের। এই ‘নিরাপদ’ ব্যবস্থা হলো মশারি দিয়ে খেজুরগাছ ঢেকে দেওয়া। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাদুড়ের লালা এবং প্রস্রাব রসে গিয়ে পড়ে। মশারি বা জাল দিয়ে এর সুরক্ষা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

একে দেশে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর একটি বিপদ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও অন্তত তিন বিপদ। বিপদ তিনটি হলো এবার শিশু-কিশোরদের বেশি আক্রান্ত হওয়া, মায়ের বুকের দুধে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি এবং নতুন একটি জেলায় এই ভাইরাস শনাক্ত হওয়া।

আইইডিসিআরের গবেষণায় দেখা যায়, চলতি বছর দেশে একজন প্রসূতির বুকের দুধে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ওই মায়ের সন্তানের পরে মৃত্যু ঘটে। বুকের দুধে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া সারা বিশ্বে একটি বিরল ঘটনা। এছাড়া এবার নতুন একটি জেলা নরসিংদীতে নিপাহ ভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে। এই রোগী পাওয়ার অর্থ হলো ভাইরাস এখন দেশের অন্য এলাকায় বিস্তৃত হয়ে পড়ছে। এটা একটা বিপদ। এখন দরকার এই বিস্তৃতি রোধ করা।

শীতের শুরু থেকেই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করেন গাছিরা। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যেও খেজুরের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম প্রিয় খাবার।

নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি জেলার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেরালা সরকার নিপাহ ভাইরাস প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশে গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে, মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও অন্য ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিতরা আক্রান্ত হয়। তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারেন।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানীরা টেরোপাস মেডিয়াস গোত্রের বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করছেন। গবেষকেরা জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে টেরোপাস মেডিয়াস গোত্রের বাদুড় থেকে ১০ ধরনের নিপাহ ভাইরাসাকে আলাদা করেন। জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এসব ভাইরাসের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মিল রয়েছে। দূর-দূরান্তের বাদুড়ের ভাইরাসের মধ্যেও মিল পাওয়া গেছে। বাদুড়গুলোর বিভিন্ন আবাসস্থলের মধ্যে আনাগোনা কিংবা চলাচলের যোগসূত্রকে এমন মিলের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

দূষিত খেজুরের রস দ্বারা শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার পর সাধারণত সংক্রমণের ৫–১৪ দিনের মধ্যে নিপাহ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে দেখা দেয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ না করেও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে প্রচণ্ড জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়।

মাথা ঘোরা, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া, ঘুম ঘুম ভাব, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রলাপ বকা ও মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণজনিত নানাবিধ স্নায়ুবিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ নিউমোনিয়া, রক্ত জমাট বাঁধা, বুকে তীব্র যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসে। তাদের দ্বারা এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে।

নিপাহ ভাইরাসে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হয়েছে সন্দেহ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই, বিশ্বের কোথাও টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। আর রোগের চিকিৎসা বলতে আছে শুধুই সাপোর্টিভ কেয়ার।

তবে এটি যেহেতু একটি এনভেলপড ভাইরাস, তাই সাবান, ডিটারজেন্ট, ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল এবং ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মাধ্যমে এই ভাইরাস ধ্বংস করা সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হলো, খেজুরের রসের তাহলে কী হবে? জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, খেজুরের গুড় খাওয়া যাবে, রস খাওয়া যাবে না। খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় খেতে কোনো বাধা নেই, এতে ক্ষতি নেই। রসের গুড় তৈরি হোক। এর চাহিদাও আছে যথেষ্ট। রস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস অর্থাৎ আগুনের উত্তাপে রস রান্না হওয়ার পর তৈরি সব খাবার খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই কাঁচা রস খাওয়া যাবে না।

ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu